প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী উস্তাদ রাশিদ খান। ছবি: সংগৃহীত।
সকালে শুনেছিলাম রাশিদের পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটজনক। তার পর আগের মতোই ভেবেছিলাম ও আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ও যে চলে যাবে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন কী বলব, কী করব— কিছুই বুঝতে পারছি না। আজকে কোনও বন্ধু নয়, আমার এক ছোট ভাইকে আমি হারালাম।
রাশিদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের পরিচয়। বিক্রম (বিক্রম ঘোষ) আমার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন। আমরা তিন জনে এক সময়ে যে কত মজা করেছি তা বলতে গেলে শব্দ শেষ হয়ে যাবে। শুধু কলকাতা নয়, একসঙ্গে বিদেশে যাওয়া, সময় কাটানো— প্রতিটা ঘটনা এখন চোখের সামনে ফুটে উঠছে। রাশিদের বাড়িতে এক সময় কত আড্ডা দিয়েছি। আমাদের চারপাশে শিল্পী হয়তো অনেকেই, কিন্তু রাশিদের মতো সরল মনের মানুষ আমি খুব দেখেছি। ওর একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল। মাঝেমধ্যেই একঘেয়েমি কাটাতে আমাকে ফোন করে প্রচুর ‘গালিগালাজ’ করত। সবটাই মজার ছলে। জিজ্ঞাসা করত, কেন দেখা করি না। কেন ওকে সময় দিই না। আমি নাকি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, ইত্যাদি। আমিও বন্ধুত্বের খাতিরে সেটা খুবই উপভোগ করতাম।
বন্ধুত্বের খাতিরেই আমার ‘মিতিন মাসি’ ছবিতে ও গান গাইতে রাজি হয়েছিল। সে-ও এক মজার অভিজ্ঞতা। আমি ওকে বলেছিলাম, “রাশিদ, শোন আমার ছবিতে তোকে একটা গান গাইতে হবে। কিন্তু তুই যে পারিশ্রমিক নিস আমি তত টাকা দিতে পারব না।” শুনে বলল, ‘‘তুই কত টাকা দিবি বল।’’ আমি মজা করে বললাম, এ রকম দেব। বেশি কথা বলিস না। চুপচাপ গানটা গেয়ে দে। আমি ভেবেছিলাম ও অন্য কিছু বলবে। কিন্তু আমায় অবাক করে বলল, ‘‘ও ঠিক আছে, তুই বিক্রমকে জিজ্ঞাসা কর, কবে গানটা গাইতে হবে।’’ আমি অবাক হয়ে গেলাম! প্রকৃত বন্ধু না হলে হয়তো কোনও পেশাদার শিল্পী এটা করেন না। যত দূর মনে পড়ছে বাংলায় আমার ছবিতেই ওর শেষ প্লেব্যাক।
রাশিদ আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট। তাই ওকে ভাইয়ের মতো দেখতাম। ওর বয়সে ও সঙ্গীত জগতে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেটা অসামান্য। প্রথম বার যখন হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে এল তার পরেও ওর সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ভিতরে মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল আমার। কারণ, ক্যান্সারের যন্ত্রণা যে কতটা মারাত্মক সেটা আমি রাশিদকে দেখে বুঝেছি। খুব খুব কষ্ট পাচ্ছিল। শেষের দিনগুলোয় আমিও ইচ্ছে করেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। কারণ, আমি বা আমরা বন্ধুরা কেউই ওদের উত্ত্যক্ত করতে চাইনি। মন থেকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম তিনি যেন রাশিদকে লড়াইয়ের শক্তি দেন। আজকে সেই লড়াইটা শেষ হল।
সঙ্গীতের পাশাপাশি রাশিদ ছিল এক জন অসাধারণ রাঁধুনি। ওর হাতের বিরিয়ানি যে খেয়েছে, সে কোনও দিন ভুলতে পারবে না। আর সেই বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য আমি খালি ঠাট্টা করতাম, রাশিদ তুই খুব কিপটে হয়ে গিয়েছিস। কবে আবার বিরিয়ানি খাওয়াবি বল। ও হেসে বলত, ‘‘প্ল্যান করলেই হল। চলে আয় আমার বাড়ি। আমি জমিয়ে বিরিয়ানি রাঁধব।’’ এই কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে। ওর হাতের বিরিয়ানি খাওয়াটা বাকি রয়ে গেল।