অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
তাঁর নাগাল পাওয়া মুশকিল। সাক্ষাৎকার দিতে বিশেষ একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু কথা বলতে শুরু করলে ঋত্বিক চক্রবর্তী অকপট। ‘সন্তান’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি ব্যস্ততার ফাঁকেই সময় দিয়েছিলেন তিনি। ছবির পাশাপাশি ব্যক্তিজীবন, বাংলা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান পরিস্থিতি এবং আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে আড্ডা দিলেন ঋত্বিক।
প্রশ্ন: আপনাকে এতটা সহজে সাক্ষাৎকারের জন্য পাওয়া যাবে ভাবিনি!
ঋত্বিক: (হেসে) কেন বলুন তো! আমি তো আছিই।
প্রশ্ন: গত কয়েক মাস ধরে আপনি কাজের বাইরে নেই। গণমাধ্যমের প্রতি হয়তো বিরক্তও।
ঋত্বিক: আজকাল সব বিষয়েই কথা ‘বলা’র একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আমার সেখানে বলার বিশেষ কিছু নেই। আমি তার মধ্যে থাকতে চাই না।
প্রশ্ন: কিন্তু এখন অনেকেই দেখছি নীরবতার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের তুলনা করছেন। ওঁর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কখনও কথা হয়েছে?
ঋত্বিক: (হেসে) না না! আমি কিন্তু কোনও অবস্থান নিইনি। আমার কিছু বলার থাকলে আমি কিন্তু ফেসবুকেও বলি। সেটাও তো আমারই বক্তব্য। তবে সেটাকে আমার কোনও ‘প্রতিবাদ’ বলে মনে হয় না। এটা এক ধরনের এক্সপ্রেশন। আর ফেসবুক পোস্টের জোরও তো মেরেকেটে ২৪ ঘণ্টা।
প্রশ্ন: এখন তো দেখছি আপনি ট্রোলারদের জবাবও দিচ্ছেন। সেই উত্তরও আবার ভাইরাল হয়।
ঋত্বিক: মাঝেমধ্যে একটা-দুটো মন্তব্যের উত্তর দিই (হাসি)।
প্রশ্ন: কটাক্ষ এড়াতে অনেকেই পাল্টা জবাব এড়িয়ে যান। আপনি সেখানে ব্যতিক্রম।
ঋত্বিক: (হাসতে হাসতে) আমি বিচলিত হয়েছি বলে যে উত্তর দিচ্ছি, তা কিন্তু নয়। আমার উত্তর ভাইরাল হলে, তখন সেই বেচারা ট্রোলারের মধ্যে একটা ‘সেলিব্রিটি’ অনুভূতি জন্ম নেয়। ট্রোলারকে নেহাতই এই আনন্দ দেওয়ার জন্য কখনও উত্তর দিই।
প্রশ্ন: ‘সন্তান’ শব্দটাকে কী ভাবে ব্যখ্যা করবেন?
ঋত্বিক: এক কথায় ব্যখ্যা করা খুব কঠিন। ব্যক্তিভেদে একাধিক অর্থ রয়েছে। অসাধারণ মমত্ব এবং দায়িত্বে ঘেরা একটা শব্দ। আর এখন বাবা হিসেবে আমার কাছে শব্দটার আরও গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে।
‘সন্তান’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) অনসূয়া মজুমদার, ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং মিঠুন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: বলা হয়, নতুন প্রজন্ম খুবই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ‘পেরেন্টিং’-এর প্রসঙ্গে বাবা হিসেবে উপমন্যুর (ঋত্বিকের ছেলে) জন্য চিন্তা হয়?
ঋত্বিক: বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কারণ, সময় সর্বদাই কমবেশি অস্থির এবং সময়ের সঙ্গে সেই অস্থিরতার ধরনটাও বদলে যায়। তবে ছেলেকে নিয়ে আমি ভীত বা সন্ত্রস্ত নই। তাকে তার মতো করে তৈরি করে দেওয়ার জন্য যতটা কাজ, সেটা আমি এবং আমার স্ত্রী (অপরাজিতা ঘোষ) করে দেব।
প্রশ্ন: আপনি ছেলেকে সময় দিতে পারেন?
ঋত্বিক: কাজ না-থাকলে মূলত বাড়িতেই থাকি। তাই মনে হয় না, সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয়।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনি আর অপরাজিতা তো দু’জনেই অভিনেতা।
ঋত্বিক: আমাদের শুটিং না-থাকলে, আমরা দু’জনেই দায়িত্ব ভাগ করে নিই। সচেতন থাকি। তা ছাড়া, আমরা না-থাকলেও ছেলে কিন্তু দিদার কাছে থাকে। তাই বলতে পারি, পারিবারিক পরিমণ্ডলেই ও বড় হচ্ছে।
প্রশ্ন: এ তো গেল আপনার সন্তানের কথা। পর্দার ‘সন্তান’-এ রাজি হওয়ার নেপথ্যে কি মিঠুন চক্রবর্তী, না কি রাজ চক্রবর্তী?
ঋত্বিক: মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ছবিতে অভিনয়ে সুযোগ পাওয়া অভিনেতা হিসেবে আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। রাজের সঙ্গেও অনেকগুলো কাজ হয়ে গেল। ওর সঙ্গে কাজ করতে খুব ভাল লাগে।
প্রশ্ন: ছবিতে আপনি ‘দুষ্টু’ সন্তান। রাজ বলেছেন, এতটা নেতিবাচক চরিত্র করার ঝুঁকি নাকি অন্য কোনও অভিনেতা নিতেন না।
ঋত্বিক: আমি খলচরিত্রের পাশাপাশি বিকৃত মানসিক চরিত্রেও অভিনয় করেছি। চরিত্রের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক কোনও দিনই তৈরি হয় না। কিন্তু শট দেওয়ার পর চরিত্রটার উপরে আমার রাগ হচ্ছে— এ রকম এর আগে কখনও হয়নি। সে দিক থেকে ‘সন্তান’-এ অভিনয় আমার কাছে কঠিন ছিল। যে হেতু ঘটনাগুলো একজন ছেলে তার বাবার সঙ্গে ঘটাচ্ছে, সেটা ভেবে মাঝেমাঝে নিজেরই বিরক্ত লাগত।
প্রশ্ন: কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল?
ঋত্বিক: না। এ রকম খণ্ড খণ্ড ঘটনা আমরা কখনও আমাদের আশেপাশে দেখেছি বা শুনেছি। তার উপর নির্ভর করেই অভিনয় করেছি। আমার চেষ্টা ছিল, যাতে আমাকে দেখে দর্শকের সত্যিই গলা টিপতে বা আমাকে চড় মারতে ইচ্ছে করে।
প্রশ্ন: আপনার বাবার কাছে আপনি নিশ্চয়ই পর্দার এই সন্তান ছিলেন না।
ঋত্বিক: বাবা-মা প্রয়াত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। বাবা আমার কাছে ছিলেন ‘হিরো’। বাবা আমায় অভিনয় করতে দেখে গিয়েছেন। আমার মনে হয়, আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি বা যা করি, তার অনেক বীজই আমার মধ্যে বাবা বপন করে দিয়ে গিয়েছেন।
ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: মিঠুনের সঙ্গে ফ্লোরে প্রথম সাক্ষাৎ মনে আছে?
ঋত্বিক: প্রথমে ফ্লোরে মিঠুনদাকে দূর থেকে দেখতাম। বিশ্বাস করতে পারিনি যে, আমার সামনে মিঠুন চক্রবর্তী শট দিচ্ছেন। ছোটবেলায় টিভিতে ‘ডিস্কো ডান্সার’ দেখানো হয়। স্কুলের পর স্কুলে সে দিন ছাত্রছাত্রী আসেনি। সংবাদপত্রে লেখালিখি হয়। সেই মানুষটার সঙ্গে অভিনয় করেছি, এখনও ভাবলে বিস্মিত হই।
প্রশ্ন: ওঁর থেকে কী কী শিখলেন?
ঋত্বিক: মানুষটার মধ্যে কোনও ক্লান্তি নেই। এই বয়সেও সমান এনার্জি নিয়ে শট দিচ্ছেন। সহ-অভিনেতাকে কিউ দিচ্ছেন। তার থেকেও বড় কথা, এত বছর ধরে অভিনয় করার পরেও নিজেকে সমান ভাবে ক্যামেরার সামনে মেলে ধরা খুব কঠিন কাজ। আমার তো সন্দেহ হয়, আমি কি কোনও দিন তাঁর মতো বয়সে এই এনার্জি ধরে রাখতে পারব?
প্রশ্ন: শুনেছি, মিঠুন নাকি ফ্লোরে তাঁর কেরিয়ারের নানা গল্প শোনাতেন?
ঋত্বিক: সে তো বলতেনই। এমন এমন সব অভিজ্ঞতা, সেগুলো হয়তো মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গেই একমাত্র ঘটা সম্ভব। যেমন মিঠুনদার থেকেই শোনা, আফ্রিকায় ঘুরতে গিয়েছেন। সেখানকার মানুষ তখন ভারতীয় বলতে শুধু মিঠুন চক্রবর্তী এবং অমরীশ পুরীর নাম শুনেছেন! মিঠুনদা বললেন, ‘‘বুঝলি তো জওহরলাল নেহরুর নামও কিন্তু ওঁরা শোনেননি।’’ কোনও বইয়ে এটা পড়া, আর স্বয়ং মানুষটার মুখ থেকে শোনা— ভাবতেই একটা শিহরন খেলে যায়।
প্রশ্ন: মিঠুনের এনার্জির কথা বলছিলেন। আপনিও তো ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় দু’দশক সম্পূর্ণ করে ফেললেন। কখনও ক্লান্তি আসে?
ঋত্বিক: কাজ করতে গিয়ে যাতে কোনও বিরক্তি না-আসে, তার জন্য আমার নিজের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া রয়েছে। তাই শুরুতেই বুঝে নিই যে কাজটা সমান গুরুত্ব দিয়ে শেষ করতে পারব কি না। কোনও বিরক্তি তৈরি হবে কি না। অভিনয় করতে ভাল লাগবে না, এ রকম কাজ খুব একটা করিনি। কেরিয়ারের শুরুর দিকে কয়েকটা করেছিলাম। পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করে অভিনয় করছি বা ভাল না-লাগলেও অভিনয় করতে হচ্ছে— এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে কখনওই ফেলি না।
প্রশ্ন: টলিউডের নির্মাতাদের কাছে ঋত্বিক মানেই ‘তুরুপের তাস’। এই তকমা আপনার কেমন লাগে?
ঋত্বিক: আমি শুনিনি। তবে এ রকম হলে সেটা একটা বড় ভরসার জায়গা। এত দিন যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করছি, তাঁরাই তো আমাকে ভরসা করে আবার কাজ দিয়েছেন। তবে এ ধরনের কোনও তকমাকে মেনে নিয়ে আমি যে প্রতিটা কাজ উতরে দিতে দিতে এগোব, এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই।
প্রশ্ন: তার মানে সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে সমান গুরুত্ব দিতে চাইছেন?
ঋত্বিক: হ্যাঁ। সব কাজে সাফল্য বিষয়টা অতিমানবীয় একটা বিষয়। কখনও ব্যর্থ হলে তো সন্ন্যাস নিতে পারব না! তাই সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে সমান গুরুত্ব দিয়েই এগিয়ে চলতে হবে।
ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আর যাঁরা বলেন আপনি টাইপকাস্ট হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের কী বলবেন?
ঋত্বিক: কারও যদি মনে হয়, তাকে আলাদা করে উত্তর দিতে রাজি নই। তার মানে সে হয়তো আমার সব ছবি দেখেনি। সব অভিনেতার সামনে টাইপকাস্ট হওয়ার ভয়টা একটা চক্রের মতো ঘুরতে থাকে। তার মধ্যে দিয়েই তাকে এগোতে হয়। কখনও সেটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে, আবার কখনও হয়তো সম্ভব হবে না। আমি ওই ফাঁদে পা না-দেওয়ারই চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: আরও ভাল অভিনয়ের জন্য আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি নেন?
ঋত্বিক: নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই অভিনেতার মূল চ্যালেঞ্জ। তার জন্য অভিনয়, গান, শরীরচর্চা, বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, ভাল ছবি বা ওয়েব সিরিজ় দেখা— অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। আমিও এই ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। সেই জন্যই হয়তো আমাকে সারা ক্ষণ পাওয়া যায় না। আর এত দিন কাজের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটা অভিনেতা হিসেবে সাহায্য তো করেই।
প্রশ্ন: সম্প্রতি একটি পরিসংখ্যানে চলতি বছরে বাংলা ছবির সংখ্যা অনেকটাই কমেছে বলে দাবি করা হয়েছে। একজন অভিনেতা হিসেবে বর্তমান সময়ে টলিপাড়ায় টিকে থাকা কি সহজ?
ঋত্বিক: (একটু ভেবে) বেশ কঠিন। কাজের সংখ্যা যে ভাবে কমছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। প্রযোজক এবং পরিচালক, সকলেই ছবির সংখ্যা কমিয়েছেন। তাই পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির একজন সদস্য হিসেবে আমি চিন্তিত। আবার ওটিটি এবং টিভিতে কাজের সুযোগ কিছুটা বেড়েছে। তবে প্রত্যেকেই এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন: আপনার মনে কখনও নিরাপত্তাহীনতা বাসা বাঁধে?
ঋত্বিক: অভিনয় যে অনিশ্চিত পেশা, সেটা জেনেই তো এসেছি। আমার কেরিয়ার কতটা দীর্ঘ হবে, সেই নিরাপত্তাহীনতা সারা ক্ষণই তাড়া করবে। তাই আমি আগে, না কি আমার আগে বা পরে কারা রয়েছেন— এই ধরনের কোনও প্রতিযোগিতায় না-গিয়ে চেষ্টা করি আমার রানওয়েটা যেন ২০ বা ২৫ বছরের হয়। তার দিকেই মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার পরেও সবটা তো আমার হাতে থাকে না। একটা খুবই সচল এবং কর্মব্যস্ত ইন্ডাস্ট্রিতেও অভিনেতাকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
প্রশ্ন: তখন বলিউডে কাজের কথা মনে হয় না?
ঋত্বিক: চাইলে একটা-দুটো হিন্দি কাজ করতেই পারি। কিন্তু হিন্দি ছবি বা মুম্বই যে আমার কেরিয়ারে পেশাদার জায়গা হয়ে উঠবে, সেটা এখনও নিজেকে বোঝাতে পারিনি।
প্রশ্ন: কেন বলুন তো! বাংলার বহু শিল্পীই তো বলিউডে এখন কাজ করছেন।
ঋত্বিক: কারণ, আমার মতে, কোনও ভাষার প্রতি দখল না-থাকলে সেখানে অভিনেতার বিশেষ কিছু করার থাকে না। এখন বলিউডে সারা ভারত থেকে কাস্টিং হচ্ছে। পরম (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়), অপুদা (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)— হিন্দিতে কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই ভীষণ যোগ্য। প্রত্যেকেই কিন্তু ডাক পান। তার মধ্যে আমিও রয়েছি। কোনও দিন হয়তো আমিও কাজ করব (হাসি)।
প্রশ্ন: চলতি বছরে আপনার মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা একটু কম।
ঋত্বিক: ওয়েব সিরিজ় বেশি। আসলে এই বছর অনেক ছবির শুটিং করেছি, যেগুলো আগামী বছরে মুক্তি পাবে। বলা যায়, ‘সন্তান’ দিয়েই সেই যাত্রা শুরু হবে।