শুটিং বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত শিল্পীরা। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবস্থা এই মুহূর্তে ‘শ্যাম রাখি না কূল’ গোছের। না ফেলা সম্ভব আর্টিস্ট ফোরামের নির্দেশ, আবার বসে থাকার উপায়ও নেই দিনের পর দিন। মঙ্গলবার রাতের পর আপাতভাবে দুই দলে বিভক্ত টেলিপাড়া। যাঁরা বুধবার থেকে কাজে নামবেন বলে টগবগিয়ে ফুটছিলেন, আশাভঙ্গ হওয়ায় তাঁরা যেন জোর করে পায়ে বেড়ি বাঁধছেন।
কোন দলে কারা?
বিষয়টি নিয়ে একটু সতর্ক হয়েই মন্তব্য করলেন ‘রাসমণি’ দিতিপ্রিয়া। তাঁর কথায়, বৈঠকে কী কী উঠে এসেছে, কী কী কথা হয়েছে, কিছুই জানেন না তিনি। ফলে, এখনই বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কথা বলায় সায় পাচ্ছেন না তিনি। তবে বললেন, “কাজ শুরু হোক, আমিও চাই সকলে কাজ করুক।তবে ইন্সিওরেন্সের বিষয়টির সমাধান করে কাজে নামাতে হবে”,সাফ জবাব ‘রানিমা’র।
আজ সকালে জানতে পেরেছেন আর্টিস্ট ফোরামের সিদ্ধান্ত। রীতিমতো অবাক ‘শ্রীময়ী’ বললেন, “আমি কাল রাত ৯টায় কলটাইম পেয়েছি। টোটা ফোন করল। ওর আর আমার সিন ছিল আজ। সকালে উঠে শুনি শুটিং বন্ধ। আমি আর্টিস্ট ফোরামের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু সুরক্ষা বিমার প্রসঙ্গ আগে মিটিংয়ে আর্টিস্ট ফোরাম কেন জানাল না? প্রযোজকরাও সবাই প্রস্তুত ছিলেন। এতে আরও অনিশ্চয়তা বাড়ল। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না।” চিন্তিত অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদার। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, আর্টিস্টরা কেউ কেউ বলছেন ফোরাম না মেনেই কাজে যোগ দেবেন। এই বিষয়টা দেখতেও ভাল লাগছে না তাঁর।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
কলটাইম পেয়ে যতটা আনন্দ হয়েছিল, সুরক্ষা বিমার জন্য কলটাইম বন্ধ জেনে একেবারে মনমরা হয়ে পড়েছেন ‘মোহর’ ওরফে সোনামণি সাহা। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “সবাই কাজে যোগ দিক আমি এটাই চাই। করোনা থাকবেই। সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে। আজ তো মিটিং আছে আবার। আজ যেন রাতে আবার আমার কলটাইম চলে আসে।কাজ শুরু হলে বিমার কাগজও হাতে পেয়ে যাব।”
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
শুটিং শুরুর ঘোষণা শুনেই দু’দিন আগে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় পা রেখেছেন ‘নকশি কাঁথা’র মুখ্য চরিত্রাভিনেতা সুমন দে। সঙ্গে ষাটোর্ধ্ব বাবা। কাজে নামার মানসিকতা নিয়ে ফেরার পরে নয়া নির্দেশ তাঁকে দোলাচলে ফেলে দিয়েছে। সুমনের যুক্তি, “ফোরামের নির্দেশ অমান্য করার কোনও প্রশ্নই নেই। একই সঙ্গে নিজেরও ভাবনা হচ্ছিল, বাড়িতে আমার সঙ্গে বাবা থাকবেন। সতর্কতা মানার পরেও শুটিং জোন থেকে করোনা নিয়ে ফিরলে তাঁর কী হবে? এদিকে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে মোটা ইএমআই। রোজগার বন্ধ করে দিনের পর দিন বসে থাকাও চাপের।”
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
তাহলে কি শুটিংয়েই ফিরতে চান তিনি? সুমনের দাবি, তিনি ফ্লেক্সিবল। যে সিদ্ধান্ত হবে তাতেই রাজি। শুটিংয়ে ডাকলে যেমন যাবেন, আপাতত অপেক্ষা করতে হলে সেটাও করবেন।
আরও পড়ুন: দিনভর টানাপড়েন, আজ থেকে শুরু হচ্ছে না বাংলা ধারাবাহিকের শুটিং
একই সুর আর এক জনপ্রিয় মেগা ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’-এর ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ সব্যসাচী চৌধুরীর কথাতে। তিনি এক পা বাড়িয়েই আছেন শুটিংয়ের জন্য। জানালেন, “আগের দিন যখন জানলাম ১০ জুন থেকে শুট শুরু, ভাল লেগেছিল। নিজেকে তৈরি করছিলাম সেই ভাবে। কিন্তু গত রাতের নির্দেশের পর সব এলোমেলো হয়ে গেল।”
এখন তাঁর চিন্তাভাবনা কী?
সব্যসাচীর সবিনয় উত্তর, “ধীরে ধীরে একটা রফা বা সমাধানের কথা এবার বোধহয় ভাবতে হবে। কারণ, আমার মতো আরও অনেকেরই কিন্তু শুটিংয়ে আপত্তি নেই।”
এখনই শুটিং ফ্লোরে ফিরছেন না, আগের সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা সেন। কিন্তু যাঁরা ফিরতে চাইছেন তাঁরা থমকে গিয়েছেন ফোরামের গত রাতের নির্দেশে। এই নিয়ে তাঁর মত কী? প্রশ্ন করতেই ‘ফাগুন বউ’ হালছাড়া গলায় বলেই ফেললেন, বৈঠক করে এতকিছু ঠিক হওয়ার পর এটা কী করল আর্টিস্ট ফোরাম! এভাবে ধুম করে রাতারাতি মত বদলের কোনও দরকারই পড়ত না আগে থেকে সব গুছিয়ে কাজে নামলে।
ঐন্দ্রিলার বক্তব্য, অনেকেই যেমন কাজ করতে চাইছেন, তেমনই অনেকে আবার কাজ করতে চাইছেনও না। সরকার ঘোষণা করতে পারে মাত্র। জোর করে কাজে নামাতে পারে কি? তাই সংগঠনের পাশাপাশি অভিনেতা-অভিনেত্রী, মেকআপ ম্যান, টেকনিশিয়ান সবার সঙ্গে বসা উচিত ছিল। সবার মত নিয়ে দরকারে আরও একটু সময় নিয়ে জুলাইয়ের শেষে কাজে নামলে সব দিক বোধহয় রক্ষা হত।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
পাল্টা প্রশ্ন অভিনেত্রীর, ‘‘অসুবিধায় সবাই। কলাকুশলী থেকে প্রযোজক, পরিচালকেরাও। কেউই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। তাই এতদিন যখন অপেক্ষা করাই গেল, আরও এক-দুটো মাস নিজেদের তৈরি করে নেওয়ার জন্য কি সময় দেওয়া যেত না?’’
অনেক অভিনেতাই যখন অভিনয়ে রাজি তাহলে শুট না করার নির্দেশ কি জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে ফোরাম? এমনটাও মানতে রাজি নন সব্যসাচী। তাঁর দাবি, অর্থনৈতিক চাপ থাকলেও ফোরাম যা করছে তা সবার ভাল ভেবেই।
কথা হয়েছিল ‘মথুরবাবু’ গৌরব চট্টোপাধ্যায়, ‘শবনম’ মানালি দে-র সঙ্গেও। মানালি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি একটি শব্দও খরচ করবেন না এখন। গৌরবের মতে, প্রযোজকের সঙ্গে মিটিং করে তারপর মুখ খোলাটাই যুক্তিযুক্ত।
আরও পড়ুন: আমি ক্যান্সারের পেশেন্ট হয়ে ইন্ডাস্ট্রির কথা ভেবে যদি শুটিং করতে পারি, অন্যরা কেন পারবেন না: ভরত কল
ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন ভীষণ ভাবিত টেলিপাড়ার অভিনেতারা সেই সময় ফোরামের এই নির্দেশে হতবাক প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ-এর সহপ্রধান মহেন্দ্র সোনি।এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, একই সঙ্গে তিনি বিস্মিত এবং ভীত রুপোলি পর্দার ভবিষ্যৎ নিয়ে। সমস্ত সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা, সুরক্ষাবিধি পালনের অঙ্গীকার সমেত সব নির্দেশিকা মানার প্রতিশ্রুতি নিয়েই আজ থেকে কাজে নামবেন বলে ঠিক করেছিলেন। আগের রাতে ফোরামের এই ঘোষণা তাঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। টেলি এবং টলিপাড়ার মঙ্গলের জন্য দ্রুত ছন্দে ফেরা খুব জরুরি, এমনটাই দাবি প্রযোজকের।
অভিনেতা থেকে কলাকুশলী থেকে পরিচালক, প্রযোজক— সবাই একবাক্যে রাজি শুটিংয়ে ফিরতে। হাতেগোনা কিছু ব্যক্তিত্ব হয়তো দোলাচলে ভুগছে। সবার মুখ চেয়ে ফোরাম কি সিদ্ধান্ত বদলাবে? এই উত্তর বোধহয় সময় দিতে পারবে।