ঝাঁ চকচকে শপিং মলে নতুন বছরের কেনাকাটার ধুম লেগেছে।
কিন্তু ট্রায়াল রুমের দরজাটা বন্ধ করলেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠছে। আয়নাগুলোর সামনে দাঁড়ালে মনে হচ্ছে যেন তাড়া করে আসছে অজানা অনেক চোখ।
সাউথ সিটির এক শো-রুমের ট্রায়াল রুমের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন রাজশ্রী মণ্ডল। চোখেমুখে টেনশন। স্মৃতি ইরানি গোয়াতে যে ভাবে বিপন্ন হয়েছিলেন, তা নাড়িয়ে দিয়েছে রাজশ্রীর বিশ্বাসের ভিত। বললেন, ‘‘হিডন ক্যামেরার ব্যাপারটা একজন মন্ত্রীকে ঘিরে বলেই এত হইচই হল। আমাদের মতো সাধারণ মেয়ের বেলায় হলে মিডিয়া-প্রশাসন এতটা এগিয়ে আসত না। তাই নিজেই সতর্ক থাকছি। ট্রায়াল রুমে ঢুকে পরীক্ষা করে নিচ্ছি চারদিক।’’
মিডিয়া, প্রশাসন কি সত্যিই সতর্ক?
দিন চারেক আগে কলকাতার আর এক নামজাদা শপিং মল-এ ফ্যাবইন্ডিয়ার শোরুমে তদন্তে মিলেছে স্পাই ক্যামেরা। সেই ক্যামেরার মুখ ঘোরানো ছিল ট্রায়াল রুমের দিকেই। ঠিক স্মৃতি ইরানির ঘটনার মতোই। জিজ্ঞাসাবাদ করায় সেখানকার স্টোর ম্যানেজার জানান ক্যামেরাগুলো নাকি কাজ করে না। আরও বলেন ভবিষ্যতে সেগুলো কাজ করলে মনিটর করা হবে দিল্লিতে ওই সংস্থার হেডকোয়ার্টার্স থেকে।
শপিং মলের ওই সংস্থার কর্মীরা হেডকোয়ার্টার্স-এর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে গা এলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন শোরুমের ট্রায়াল রুম অ্যাটেনডেন্টরা কী বলছেন?
সাউথ সিটির এক শোরুম অ্যাটেনডেন্ট বললেন, ‘‘আমাদের এখানে ছেলেদের ট্রায়াল রুম এক দিকে। মেয়েদের ট্রায়াল রুম আরেক দিকে। সিসিটিভি ক্যামেরা সারা শোরুমে তাক করা থাকলেও ট্রায়াল রুমে কোনও ক্যামেরা নেই। ঢুকে দেখে নিতে পারেন।’’ অন্য এক শোরুমের আর এক অ্যাটেনডেন্ট অতটাও রুখে দাঁড়লেন না। নাম গোপন রেখে বললেন, ‘‘দেখুন, স্মৃতি ইরানি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। অনেক কিছুই তাই ঘটে থাকতে পারে। তবে কর্পোরেট কন্সপিরেসি না হওয়ারও কোনও কারণ দেখছি না।’’
কিন্তু শোরুমে চুরি বন্ধ করার তাগিদে ক্রেতাদের গোপনীয়তাকে এ ভাবে অসম্মান করা হবে?
গোপন ক্যামেরায় নজরবন্দি আপনার নগ্নদেহ। সেই সব ছবি এমএমএস, ভিডিয়ো ফুটেজ হয়ে অজান্তে নিঃশব্দ-বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় পর্নোগ্রাফির সাইটগুলোতে।
এ কি শুধুই ভয়্যারিজম? না কি এক ধরনের অপরাধ প্রবণতা!
মনস্তত্ত্ববিদ জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘ভয়্যারিজম চিরকালই ছিল। তবে হ্যাঁ, ছেলেরা এটা করে বেশি আনন্দ পায়। স্পাই ক্যামেরাতে যারা মেয়েদের এ ভাবে দেখছে, তারা কৌতূহলবশত এক-আধবার দেখতে পারে। কিন্তু বারবার দেখতে গিয়ে এটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। এরা বিকৃত রুচির। সেক্সুয়ালি পারভারটেড। আর যারা করছে, তারা এই পাওয়ারটাও এনজয় করে। আড়ালে একজনকে দেখার ক্ষমতা। এটা অবশ্যই এক ধরনের মানসিক বিকার।’’
ফ্যাবইন্ডিয়ার ঘটনায় জামিন পেয়ে গিয়েছেন গোয়ার ওই সংস্থার চার কর্মী। শহরের কিছু আইনবিদ এতে স্পষ্টতই হতাশ। ক্রিমিনাল ল-ইয়ার অসীমেশ গোস্বামী বললেন, ‘‘উচিত ছিল ৩৫৪ সি ধারায় চার্জশিট দেওয়া। তদন্ত করা উচিত ছিল কারা ক্যামেরা ইন্সটল করেছেন। কারা সেই ক্যামেরা অপারেট করেছেন। ওই সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল। তা না করে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হল। রাজনীতির উর্ধ্বে ঘটনাটাকে দেখার দরকার ছিল। কিন্তু কিছুই হল না। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ ভাবে হেনস্তা হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়!’’
নিরাপত্তার অভাবেই চিকিৎসক মনস্বিতা বিশ্বাস বা অধ্যাপিকা ঝিলম মিত্র অনেক দিন থেকেই ট্রায়াল রুমে ঢোকা ছেড়ে দিয়েছেন। মনস্বিতা বললেন, ‘‘ড্রেস মাপমতো না হলে পরে চেঞ্জ করে আনি। ফ্যাবইন্ডিয়াতেই যদি এ রকম হয়, তা হলে বাকি জায়গাগুলোর নিরাপত্তা কোথায়!’’ ঝিলম আবার অনেক দিন আগে থেকেই ট্রায়াল রুমে ঢুকে চেক করার চেষ্টা করেন কোথাও লুকনো ক্যামেরা রয়েছে কি না। বললেন, ‘‘আমি আগে ট্রায়াল রুমে আয়নায় আঙুল চেপে বোঝার চেষ্টা করতাম। অনেক সময় হুকে ঝোলানো জামাকাপড় সরিয়েও দেখতাম। কোনও দিন এ রকম অভিজ্ঞতা হয়নি। এখন নো ট্রায়াল রুম।’’
এত কিছুর পরেও অনেকেই কিন্তু বেশ নিরুত্তাপ।
মধ্য কলকাতার এক মল-এর ট্রায়াল রুমের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লেকটাউন-এর রুশা মাথুর। স্মৃতি ইরানির ঘটনা তিনি নাকি জানেনই না। উল্টে বলেন, ‘‘হেডলাইন হওয়ার জন্য কত ঘটনাই যে ঘটে!’’
লেকটাউনের রুশা না-ও জানতে পারেন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, সাবধানের মার নেই।
কে বলতে পারে, স্পাই ক্যামেরা আপনার দিকেও তাক করা নেই!
স্মৃতি ইরানির ঘটনায় রাজনৈতিক কোনও রং খুঁজতে চাই না। শ্যুটিংয়ে গিয়ে একাধিক হোটেলে উঠতে হয় আমাকে। আমি চেষ্টা করি একই হোটেলে উঠতে। অনেক দিন আগে এক আর্টিকেলে পড়েছিলাম আয়নার পিছনেও গোপন ক্যামেরা ফিট করা থাকে। শপিং মল-এর ট্রায়াল রুমে বা হোটেলের ঘরে ঢোকার আগেও আতিপাতি করে দেখে নিই গোপন ক্যামেরা ইন্সটল করা আছে কিনা। আমি বরাবরই সতর্ক ছিলাম। এই সব ঘটনা আরও সতর্ক করে দিয়েছে। রূপা গঙ্গোপাধ্যায় (অভিনেত্রী ও বিজেপি সদস্য)
কোনও দোকানের ট্রায়াল রুমই আর নিরাপদ নয়। ফ্যাব ইন্ডিয়ার মতো আউটলেটে এ রকম ঘটনা ঘটলে সাধারণ দোকানে তো হতেই পারে। সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় (লেখিকা)
যারা গোপন ক্যামেরা রাখার কাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়। তা না হলে এমন ঘটনা বারবার ঘটবে। চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় (অভিনেত্রী-পরিচালক)
ট্রায়াল রুমে নিরাপত্তা পুরুষ-মহিলা দুয়েরই প্রয়োজন। তবে আমি মনে করি সেফটি, সিকিওরিটি আর প্রাইভেসি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। দুটোকে মেশানোর কোনও দরকার নেই। ট্রায়াল রুম হোক বা টয়লেট— স্পাই ক্যামেরা সেখানে থাকবে কেন? এগুলো তো অত্যন্ত ব্যক্তিগত জায়গা। ডা. রূপালি বসু (প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড সিইও, ইস্টার্ন রিজিয়ন, অ্যাপোলো হসপিটালস গ্রুপ)