নওয়াজিয়ানা

তাঁর অভিনয়ের আসল তেজ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর রাগ। ‘কহানি’র সেই ‘ইন্সপেক্টর খান’কে পরের ছবিতে নিতে চলেছেন ‘ইন্সপেক্টর রানা’। সহ-অভিনেতা এবং বন্ধু নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি-কে নিয়ে লিখছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়দুপুরবেলা। এমনিই বসে বসে আমাদের মেক আপ ভ্যানে সিগারেট খাচ্ছিলাম আমি আর ও। সকালে শ্যুটিং স্পটে পৌঁছতেই পরিচালক সুজয় ঘোষ আমাকে আলাদা করে বলে দিয়েছিল, ‘‘পরম, ‘কহানি’র খুব গুরুত্বপূর্ণ সিনের শ্যুটিং কিন্তু আজকে। রেডি থাকিস।’’ সেইমতো ভ্যানে বসে কনসেনট্রেট করছি। এর মধ্যেই সুজয়ের অ্যাসিসটেন্ট এসে বলল শট রেডি। পরে ‘কহানি’র ওই সিন-টা নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share:

দুপুরবেলা। এমনিই বসে বসে আমাদের মেক আপ ভ্যানে সিগারেট খাচ্ছিলাম আমি আর ও। সকালে শ্যুটিং স্পটে পৌঁছতেই পরিচালক সুজয় ঘোষ আমাকে আলাদা করে বলে দিয়েছিল, ‘‘পরম, ‘কহানি’র খুব গুরুত্বপূর্ণ সিনের শ্যুটিং কিন্তু আজকে। রেডি থাকিস।’’ সেইমতো ভ্যানে বসে কনসেনট্রেট করছি। এর মধ্যেই সুজয়ের অ্যাসিসটেন্ট এসে বলল শট রেডি। পরে ‘কহানি’র ওই সিন-টা নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। অনেকে এটাও বলেছে বা লিখেছে যে ওই একটা সিনই আমার সহ-অভিনেতার পুরো জীবনটাই নাকি বদলে দিয়েছে। সিন-টা নিশ্চয়ই মনে আছে। ছবির শেষের দিকে পুলিশ স্টেশনে আমাকে মানে ‘ইন্সপেক্টর রানা’কে ধমকাচ্ছে ‘ইন্সপেক্টর খান’। প্রথম বার রিহার্সাল হল, সুজয়ের মনোমত হল না। ‘‘ওয়ান্ট মোর ইনটেনসিটি। এ বার টেক-এ যাব,’’ বলল সুজয়।

Advertisement

ক্যামেরা অন। সিন শুরু। চেঁচিয়ে উঠল আমার সহ-অভিনেতা। এতটাই ইনটেনসিটি ছিল গলায় যে ফ্লোরে সবাই তখন ওকেই দেখছে। সুজয় আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল, ‘‘তুই শুধু গোবেচারা হয়ে থাকিস।’’

সহ-অভিনেতার ওই চেঁচানো দেখে ততক্ষণে আমি আরও গোবেচারা। আমার যে এক্সপ্রেশনটা ফিল্মে আপনারা দেখেছেন, সেটা কিন্তু একেবারে রিয়েল রিঅ্যাকশন। নওয়াজ যখন ‘আউট’ বলে চোখের ওই এক্সপ্রেশনটা দিল, আমি আর বিদ্যা দু’জনেই হা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের এক্সপ্রেশনটা জলজ্যান্ত। একটুও অভিনয় নয়। একজন শান্ত মানুষ ক্যামেরার সামনে কী করে এতটা বদলে যেতে পারে, আমি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটাই ভাবছি।

Advertisement

সুজয় ‘কাট’ বলল। দেখি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ও। কাছে আসতেই বলল, ‘‘সরি ইয়ার, থোড়া জাদা চিল্লা দিয়া তেরে উপর পরম। মাইন্ড মত কর না।’’

‘কহানি’ করার আগে আমি ওকে ‘এক চাল্লিশ কী লাস্ট লোকাল’-এ প্রথম দেখেছিলাম। তার পর দেখেছিলাম জন আব্রাহাম-ক্যাটরিনা কইফ অভিনীত ‘নিউ ইয়র্ক’-এ। এবং তার পর ‘পিপলি লাইভ’-এ। খুব বেশি সময় স্ক্রিনে ছিল না নওয়াজ কিন্তু ওইটুকু সময়েই চমকে দিয়েছিল ওর অভিনয়। তার পর ‘কহানি’র শ্যুটিং শুরু হল। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হল ওর সঙ্গে।

‘কহানি’র শ্যুটিং করতে করতে বহু দিন ভেবেছি এ রকম বেঁটে একটা লোক কী ভাবে এত ইনটেনসিটি আনে নিজের মধ্যে! একটা বেঁটে লোকের এত তেজ হয় কী করে? কিছুতেই উত্তর পেতাম না। আজ ওর বিষয়ে লিখতে বসে অনেক কিছুই মনে পড়ছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, ওর ‘স্ট্রাগলিং পিরিয়ড’-টা অনেক দিনের। প্রায় ১৮ বছর সাঙ্ঘাতিক অভাব-অনটনের মধ্যে কাটিয়ে তবে ও ব্রেক পেয়েছে। আজও যখন অনেকেই ‘কহানি’র ইনটেনসিটি বা অন্য ফিল্মে ওর অভিনয়ের তেজের কথা বলে, আমার মনে হয় সেটা আসে ওর ওই দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে। এনএসডি-র কোনও কোচিং ক্লাস থেকে নয়।

সেই রাগ, সেই ফ্রাস্ট্রেশনটাই বেরোয় ওর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে।

শুধু কি অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বেরোয়? না বোধহয়। ভুল বললাম।

আর একটা ঘটনায় বুঝতে পারবেন রাগটা ওর রিয়েল লাইফেও থেকে গিয়েছে। একদিন বিদ্যা (বালন)-র শট চলছে। আমি আর নওয়াজ মেক আপ ভ্যানে বসে আছি।

আমাদের যারা খাবার দেয়, সেই হারুদের কাছে চা চাইল নওয়াজ। শ্যুটিংয়ে যা হয় আর কী! কোনও কারণে চা দিতে হয়তো একটু দেরি হচ্ছিল। আমি এর মধ্যেই মেক আপ ভ্যান থেকে বেরিয়ে হারুদের বললাম, ‘‘নওয়াজের জন্য একটু চা পাঠা ভেতরে।’’ তার পর ঠিক এক মিনিট কেটেছে। দেখি নওয়াজ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কানদুটো লাল এবং গলা সপ্তমে, ‘‘আরে, ইতনা দের সে থোড়া সা চায়ে মাঙ্গ রহা হু, টাইম মে দেনে কে লিয়ে কেয়া যাতা হ্যায়।’’

যে ভাবে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলেছিল, তাতে সবাই বেশ অবাকই হয়েছিল। আমিও ভাবছি, কী হল? শ্যুটিং চলাকালীন এ রকম দেরি তো হয়েই থাকে। ১০-১৫ সেকেন্ড কাটতেই দেখলাম অন্য মানুষ। সবাইকে আলাদা আলাদা করে সরি বলল চেঁচানোর জন্য। মেক আপ ভ্যানে ঢুকে আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘‘কেয়া হুয়া নওয়াজ ভাই? আপ ইতনা গুসসা মে কিঁউ আ গয়ে?’’

তার পর যেটা বলেছিল সেটার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘‘পরম, বহু দিন কষ্ট করছি। জুনিয়র আর্টিস্ট ছিলাম তো, কেউ কখনও চা বা খাবার সময়ে দিত না। সেই রাগ, সেই ফ্রাস্ট্রেশনটাই আজ বেরোল।’’ সে দিন মানুষ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিকে আর একটু চিনেছিলাম।

তার পর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব বাড়ল। ‘কহানি’র পর চোখের সামনে দেখলাম ওর জীবনটা কী রকম বদলে গেল।

ধীরে ধীরে, ‘ইন্সপেক্টর খান’ ভারতের অন্যতম সেরা অভিনেতা হয়ে উঠল। একটার পর একটা অ্যাওয়ার্ড। সমালোচকদের প্রশংসা। বড় ব্যানারের ছবি। সলমন খানের ছবির ভিলেন— আজ আমার বন্ধু সত্যিই বিগ লিগ-এ।

নওয়াজের মধ্যে একটা ‘স্মল টাউন সিনড্রোম’ আছে। নওয়াজ আজকে স্মল বাজেট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আর্ট হাউজ ইন্ডিয়ান সিনেমার ‘দ্য মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট ফেস’। ইরফান (খান) অন্য লিগে চলে যাওয়ার পর নওয়াজ সেই জায়গাটা অনায়াসে নিয়ে নিয়েছে।

নওয়াজ ছোট ছোট ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি করলেও, সলমান খানের ভিলেন হয়ে ‘কিক’‌য়ে ওই হাসিটাই কিন্তু ওকে বেশি টানে। অনেক ব়ঞ্চনা, বহু বছরের স্ট্রাগলের পর আজকে ও ম্যাক্সিমাম লোককে ওর অভিনয় দেখাতে চায়। শুধু মুষ্টিমেয় কিছু লোক ওর ছবি দেখুক সেটা ও চায় না।

এর মধ্যে মুম্বইয়ের ভারসোভাতে ওর ফ্ল্যাটে আড্ডা হয়েছে। নওয়াজ অসম্ভব সিগারেট খায়। ওর ঠোঁটে সিগারেট দেখলেই ওর ছোট মেয়ে এসে বলে, ‘নো চান্স’। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে নওয়াজ, না ইরফান— কে বেটার অভিনেতা?

দু’জনেই আমার অসম্ভব প্রিয়, তাই নম্বর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, নওয়াজ হৃদয় দিয়ে অভিনয় করে আর আজকের ইরফান মাথা দিয়ে। এটা পুরোটাই আমার অ্যাসেসমেন্ট।

আর এখানে আনন্দplus-এর পাঠকদের একটা এক্সক্লুসিভ খবর সবার আগে দিয়ে রাখি।

আমার একটা ফিল্মের জন্য ওকে নিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট লেখা আছে। এই নিয়ে নওয়াজভাইয়ের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি। হয়তো পরের বছরের মাঝামাঝি ‘ইন্সপেক্টর খান’ পরিচালক ‘ইন্সপেক্টর রানা’র ছবিতে কাজ করবে। সব কিছু ফাইনাল হলে অবশ্যই আপনারা জানতে পারবেন।

লেখা শেষ করার আগে শুধু একটা জিনিসই চাইব। নওয়াজ ভাল থাকুক, সত্যি বড্ড সিগারেট খায়, তাই সিগারেট খাওয়াটা একটু কমাক। আর আরও ভাল ভাল অভিনয় করুক যা দেখা আমরা যেন চমকে যাই।

চমকে যাই... — না, ‘চমকে যাই’টা বোধ হয় ঠিক লিখলাম না!

চাই আরও ভাল অভিনয় করুক, যা দেখে আমরা যেন থতমত খেয়ে যাই। ঠিক সে দিনের কালীঘাট পুলিশ স্টেশনে যা হয়েছিল ‘ইন্সপেক্টর রানা’র।

স্যালুট ‘ইন্সপেক্টর খান’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement