Harry Belafonte

জামাইকার সেই মেয়েটিকে দেখেছে কলকাতাও! গান আর প্রতিবাদ রেখে ফেয়ারওয়েলে বেলাফন্টে

শতাব্দীকে দেখেছেন বেলাফন্টে। সময়ের অগণিত দাবিকে কণ্ঠে তুলে এনেছেন। শুধু গান নয়, অভিনয়, সর্বোপরি মঞ্চে তাঁর অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স— ভোলা যাবে না কিছুতেই।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ২১:২৫
Share:

সে শুধু গানের দিন! রেকর্ডিংরত হ্যরি বেলাফন্টে। — ফাইল চিত্র।

কিছু বাঙাালি তাঁকে চিনত ‘পথের প্রান্তে কোন সুদূর গাঁয়ে’-র আসল তথা ইংরেজি ভার্সনের স্রষ্টা হিসেবে। কিছু বাঙালির কাছে তিনি নিপীড়িত মানুষের মুক্তির গানের কাণ্ডারি। আর আবিশ্ব অগণিত তরুণের কাছে তিনি ‘মাতিলদা’-মাতানো, ক্যালিপ্সো গানের ভুবনায়ন ঘটানো, অসামান্য রসিক এক ব্যক্তিত্ব, যিনি গানের ব্যাকরণ না মেনেও ব্যাকরণ সিং, যিনি মঞ্চে উঠলে কী যে করতে পারেন আর কী যে পারেন না, বলা দুষ্কর। হ্যারি বেলাফন্টের সঙ্গে বঙ্গজনের সম্পর্ক হ্যাজাক জ্বলা গণসঙ্গীতের আসর থেকে কলেজ ফেস্টের ঝলমলে মঞ্চে। গিটার বাজাতে শিখলে বাঙালি কিশোর এখনও ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ গায়। অদূরবর্তিনী কিশোরীর ছলছলে চোখে ছায়া পড়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের। কলকাতাই তখন কিংসটন টাউন, প্রেমের নতুন পাঠ নিচ্ছে যে যুগল, তাদের পথে ছায়া দেয় নারিকেলবীথি, অলক্ষে বেজে ওঠে ‘কোকোনাট উওম্যান’। সকলের বন্ধুর নাম হ্যারি বেলাফন্টে। সকলের হাত ধরে ‘ওয়ানস আগেইন নাও...’ বলে হাঁক দেন তিনি। আবার শহর মেতে ওঠে ক্যালিপ্সোর তালে।

Advertisement

নিউ ইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ পল্লি হার্লেমে ১৯২৭ সালে জন্ম হ্যারি বেলাফন্টের। বাবা-মা জামাইকা থেকে আগত। ১৯৩২ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত থেকেছেন জামাইকায়। পরে আবার নিউ ইয়র্কে ফিরে আসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে বন্ধুত্ব হয় অভিনেতা সিডনি পয়টারের সঙ্গে। জুটি বাঁধেন দুই বন্ধু। নাটক নিয়ে পাগলামির দিন তখন, ‘আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটার’ নিয়ে দিনবদলের স্বপ্ন। এরই পাশাপাশি ক্লাব সিঙ্গার হিসেবে নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন আসরে আবির্ভাব। গান বদলাচ্ছে সেই সময়। বদল আসছে ব্লুজ়-এর চেনা রিদম-এ, কিছু পাগল আর উন্মনা তরুণ স্বপ্ন দেখছেন যুদ্ধে দুমড়ে যাওয়া দুনিয়াকে আবার কী করে বদলে দেওয়া যায়। হ্যারিও শামিল হন তাঁদের সঙ্গে। প্রথম জীবনে ব্লুজ় শিল্পী হিসেবেই পরিচিতি ঘটে তাঁর।

১৯৫৬ সালে ‘ক্যালিপ্সো’ নামেই তাঁর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ পায়। বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষের বেশি বিক্রি হয় সেই রেকর্ড। ‘মাতিলদা’ মাতাতে থাকে পাব থেকে প্রান্তর, পাঁচতারা হোটেলের বলরুম থেকে ঘেটো-বাসী মানুষের সান্ধ্য পানের আসর। অচিরেই ‘কিং অব ক্যালিপ্সো’ হিসেবে পরিচিতি পান বেলাফন্টে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের গান বেরিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ে।

Advertisement

লোকটা নিজেই যখন একটা গান, আস্ত একটা গান। — ফাইল চিত্র।

অগণিত গান, অগণিত ধারার গান, অসংখ্য রসের গান গেয়েছেন তাঁর ৯৬ বছরের জীবনে। গসপেল, ব্লুজ, স্পোকেন ওয়ার্ডস— কী নেই তাঁর ঝুলিতে। যখন নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন অন্য শিল্পীর সৃজন, তখন অন্য মাত্রা পেয়েছে সেই গান। নিল ডায়ামন্ডের ‘প্লে মি’ তো প্রেমের অন্য অভিজ্ঞান হয়ে রয়েছে তাঁর কণ্ঠে! ‘মামা আফ্রিকা’ মিরিয়াম মাকেবার সঙ্গে গাওয়া ‘মালাইকা’ শুনলে মিহি তুষারের মতো প্রেম ঝরে পড়বে গ্রীষ্মমণ্ডলের পিচগলা দুপুরবেলাতেও।

ষাটের দশকের আমেরিকার মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম শরিক বেলাফন্টে। মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। গলায় বেজে উঠেছে ‘জন হেনরি’। ম্যাকার্থি জমানায় কালো-তালিকায় নাম ওঠা বোলাফন্টে তোয়াক্কা করেননি কিছুরই। ২০০৫-এও সরব হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার নিয়ে।

তবে গানের জগতে বিতর্কের বাইরে ছিলেন না বেলাফন্টে। ক্যালিপ্সো গানকে মূল শিকড় থেকে তুলে এনে তাকে নিউ ইয়র্ক বা লস এঞ্জেলেসের মতো নাগরিক পরিমণ্ডলের মাপসই করে পরিবেশন করছেন, এমন আপত্তি তোলেন অনেকেই। তবে তাতে মহিমা খোয়া যায়নি ‘স্ক্র্যাচ, স্ক্র্যাচ মি ব্যাক’ বা ‘বানানা বোট সং’-এর। বিবাহিত বা রোম্যান্টিক জীবনেও বেশ চর্চাতেই ছিলেন আজীবন। বিয়ে করেছেন তিন বার। শেষতম বিয়ে ২০০৮-এ, ৮১ বছর বয়সে। ক্যারিবায়ান সৈকতের মতোই রৌদ্রকরোজ্জ্বল জীবন থেমে গেল ৯৬-এ এসে।

অভিনেত্রী জেন ম্যনসফিল্ড ও বন্ধুদের সঙ্গে হ্যারি বেলাফন্টে। — ফাইল চিত্র।

শতাব্দীকে দেখেছেন বেলাফন্টে। সময়ের অগণিত দাবিকে কণ্ঠে তুলে এনেছেন। শুধু গান নয়, অভিনয়, সর্বোপরি মঞ্চে তাঁর অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স— ভোলা যাবে না কিছুতেই। উডি গুথ্রি, লিডবেলি থেকে বেলাফন্টে এক দিকে যদি কালো মানুষের কণ্ঠে ভাষা জুগিয়ে থাকেন, তবে বেলাফন্টে-এলভিস-নিল ডায়ামন্ডও একটা সমান্তরাল যুগ। ভালবাসার, আশ্লেষের, এক্সট্যাসির।

রাত ন’টায় কিছুটা বিষণ্ণ কি শহর কলকাতা? পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয় কি আজও কেউ ব্লুজ় গান? গিটার সঙ্গে নিয়ে কবে চলে গিয়েছেন এই শহরের কিংবদন্তি শিল্পী কার্লটন কিটো। ব্লুজ়ের জটিল অলিগলি পেরোতে পেরোতে হঠাৎই বাজিয়ে ফেলতেন ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’। আনমনে গোপা ঘোষ কত দিন আকাশবাণী কলকাতার ক্যান্টিনে গুনগুনিয়ে উঠতেন ‘মালাইকা’। কেউই কি নেই আর!

নাঃ। ওই তো দুপুরের রোদ ভাসিয়ে দিচ্ছে কলেজ ক্যান্টিনের চেয়ার-বেঞ্চির ফাঁকফোকর। একলা এক উলুখুলু দাড়ির কিশোর গিটারে টুংটাং করতে করতে হঠাৎ গেয়ে উঠল ‘অ্যাঞ্জেলিনা’। এলোমেলো চুলের যে মেয়েটি গতকাল রাতে তার ফোন কেটে দিয়েছিল, এক পা এক পা করে সে এগিয়ে আসছে তার দিকে। পিছনে এক অপূর্ব বিভায় ভেসে ওঠা মুণ্ডিত মস্তক মানুষের অবয়ব। কলকাতা আপনাকে ভুলবে না বেলাফন্টে। অন্তত ‘তোমাকে চাই, অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’— এই অভিব্যক্তি যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন আপনি থাকবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement