সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধঘণ্টা বাদে এলেন তিনি। মুম্বইয়ের বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে এসে বললেন,
‘‘এখানে তো সূর্য দেরি করে অস্ত যায় তাই আমরা মুম্বইবাসীরা একটু দেরিতে চলি।’’ হঠাৎই হাত থেকে আই ফোন পড়ে খারাপ হয়ে যাওয়ায় বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ‘জগ্গা জাসুস’য়ের ফ্লোরে সদ্যই রণবীরের শট দেখে এসেছেন। সেই নিয়ে বলতে বলতেই আড্ডা শুরু হয়ে গেল।
‘জগ্গা জাসুস’য়ে কি দর্শক অন্য এক রণবীরকে দেখতে পাবে?
রণবীর এই ছবিতে হিরোর চেয়ে অনেক বড় অভিনেতা হয়ে আসবে। আমাদের দেশে আজকের প্রজন্মে এই রকম গড গিফ্টেড অ্যাক্টর হিরো পাওয়া সত্যি মুশকিল। ওরকম খানদানি বংশের মানুষ হয়ে নিজেকে এত সিম্পল রাখতে পেরেছে সেটা দেখে অবাক লাগে। আমার স্টুডিয়োতে গান শুনতে শুনতে মাটিতেই শুয়ে পড়ল। বললাম করছটা কী? ও বলল, ‘‘মাটি আমার জায়গা।’’ রণবীর এই ছবিতে আর রণবীর কপূর নেই। চরিত্র হয়ে গেছে। আর আমার মনে হয় অনুরাগের সঙ্গে কাজ করলে রণবীর অন্য রকম হয়ে যায়।
কীরকম?
অনুরাগ প্রতিভা বের করে আনতে জানে। আমিও যেমন অপেক্ষা করে থাকি কবে ওর সঙ্গে কাজ করব। ও ওর ছবিতে মিউজিককে অন্য একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। ‘জগ্গা জাসুস’ আমার জীবনে সব চেয়ে চ্যালেঞ্জিং আর টাফেস্ট ছবি। অনুরাগ না থাকলে এই ছবিটা আমি করতে পারতাম না। ইন্ডাস্ট্রিতে ও আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু। তাই ওর সঙ্গে কাজ করলে খুব মজা পাই।
আর কর্ণ জোহর? ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ পরিচালনা করছেন উনি। পরিচালক হিসেবে কেমন লাগছে?
কর্ণ খুব পরিষ্কার। ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ একটা রোম্যান্টিক ড্রামা। ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন, রণবীর কপূর, অনুষ্কা শর্মা এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। কর্ণের মতো একজন ডিরেক্টর-প্রডিউসরের সঙ্গে কাজ করা অনেক সহজ। কর্ণ খুব ‘ইনস্টিংক্টিভ’। ও কী চায় স্পষ্ট বলে দেয়। খারাপ লাগলে মুখের ওপর বলে দেবে। ওর মতো রসিক পরিচালক আমি আর দেখিনি। আমি আর অমিতাভ (ভট্টাচার্য) ওর সঙ্গে মিটিংয়ের সময় শুধু হেসেই যাই। উফ্ফ! ইন্ডাস্ট্রির সব হাঁড়ির খবর কর্ণ জানে। আর সেগুলো যা মজা করে বলে ও। মিউজিকটাও চমৎকার বোঝে কর্ণ। রণবীরের কতগুলো শট দেখলাম এই ছবিতে অসাধারণ। দর্শক খুব এনজয় করবে।
অমিতাভ আর প্রীতম এখন মুম্বইয়ের সব চেয়ে হিট জুটি।
নয় নয় করে ছ’টা ছবিতে কাজ হল আমাদের। ‘দঙ্গল’য়ে কাজ করলাম।
আপনার স্টুডিয়োতে একই মাসে নাকি আমির–শাহরুখ-সলমন আসতেন?
উফফ! সে এক অভিজ্ঞতা। আমি বোধ হয় ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম মিউজিক ডিরেক্টর যে আমির, সলমন, শাহরুখের হোম প্রোডাকশনে কাজ করেছি। সলমনের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, শাহরুখের ‘দিলওয়ালে’, আমিরের ‘দঙ্গল’।
তিন খানের মধ্যে কে বেশি প্রিয়?
তিনজনই প্রিয়। সলমন সোজাসাপ্টা মনে যা আসে বলে দেবে। ঘুরিয়ে কিছু বলবে না। শাহরুখ ভালবাসা ছড়িয়ে বেড়াবে। ও আমার স্টুডিয়োতে এলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কমপক্ষে কুডি মিনিট ও নীচে ওর ফ্যানেদের সময় দেয়। সেলফি তোলে। সকলের সঙ্গে মজা করে। আমি বলি তুমি স্টুডিয়োতে এসো না, আমি যাচ্ছি। কে শোনে কার কথা? শাহরুখ খুব আন্তরিক। আর আমির খুব পারফেক্ট। ডিটেলিংয়ে বিশ্বাস করে।
আচ্ছা আপনি তো পঞ্চগনিতে আমিরের বাংলোয় ছিলেন।
হ্যাঁ, ‘দঙ্গল’য়ের জন্যই ওর বাংলোয় ছিলাম। ‘দঙ্গল’ কুস্তিগিরের ছবি। আমির বলেছিল এই ছবিতে মিউজিক করতে হলে আমাকে আর অমিতাভকে কুস্তি সম্পর্কে সব জানতে হবে। আমির কুস্তিগিরের অভিনয় করে দেখিয়েছিল আমাদের। তবে এখন ‘জগ্গা জাসুস’ নিয়ে টেনশন হচ্ছে।
‘জগ্গা জাসুস’য়ের ফ্লোর ছেড়ে প্রীতম হঠাৎ রিয়্যালিটি শোয়ের ফাঁদে পা দিলেন?
‘জগ্গা জাসুস’ করতে গিয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা ছবি যার একেকটা দৃশ্য একেক রকম মিউজিক ডিমান্ড করছে। উফফ্ লোকে যখন ছবিটা দেখবে বুঝবে মিউজিকটা কত শক্ত ছিল। তবে ‘জগ্গা জাসুস’ শেষ করে আমি ব্রেক নিতে চাই। এই ব্রেকের সময় রিয়্যালিটি শোয়ের কাজটা করব ঠিক করেছি। রিয়্যালিটি শো হঠাৎ ফাঁদ কেন হতে যাবে? এখানে তো আগামীর গায়কগায়িকা তৈরি হচ্ছে। এটা কি কম কথা?
গায়ক গায়িকা তৈরি হচ্ছে, আবার হারিয়েও যাচ্ছে?
আমি রিয়্যালিটি শো থেকেই আমার গায়কগায়িকাদের পেয়েছি। দেখুন রিয়্যালিটি শো এখন এই প্রজন্মের সিঙ্গারদের একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। জিয়াগঞ্জের অরিজিৎকে কি আমরা আগে থেকে চিনতাম?
দেখুন রিয়্যালিটি শোয়ের সাফল্যের কথা এলেই আমরা শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিংহের নাম বলি...কিন্তু তার পর?
না। আরও নাম আছে। ঋতু পাঠক মধ্যপ্রদেশের গ্রাম থেকে এসেছিল। আরও আছে। ভূমি ত্রিবেদী। রিয়্যালিটি শো না থাকলে কে চিনত এদের? মুম্বইয়ের মতো শহরে এদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, আর কী চাই? আমাদের সময়ে এই সাপোর্ট ছিল না কিন্তু। আমরা মুম্বইতে যে ভাবে স্ট্রাগল করেছি সেটা সাঙ্ঘাতিক। দুপুরে খাবার খেয়ে ভাবতে হত এত কম পয়সায় রাতে কী খাব? একের পর এক জিঙ্গলস বানাতে হয়েছে। আর একটা গান তৈরি করে সেটা হিট করানো যে কী শক্ত। এদের সেটা তো করতে হচ্ছে না। এত সাপোর্ট রিয়্যালিটি শো থেকেই তো পেয়ে যাচ্ছে।
এখানে প্রতিযোগীরা অন্যের গান করেন। তাঁদের নিজেদের গান নেই...
হ্যাঁ এটা ঠিক। তবে অন্যের গান গেয়ে যদি নিজেরা বিজনেস ক্লাসে ট্রাভেল করে তা হলে ক্ষতি কী?
আপনি বছরে আঠেরো থেকে কুড়িটা ছবি করেন। পরের বছরে প্ল্যানিং আপনার রেডি। রিয়্যালিটি শো-য়ে মেন্টর হলে তো ছবির কাজ কমে যাবে।
দেখুন অনেক ছবিতে কাজ করেছি। এ বার ঠিক করেছি ছবির কাজ কমিয়ে দেব। আর অ্যাকশন ফিল্ম করব না। অনেক করেছি।
সেকী? কেন ? ‘ধূম’ বা ‘রেস’য়ের জন্যও তো প্রীতমের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
ফাইট সিকোয়েন্সের ছবিতে আসলে গানের কোনও দরকার পড়ে না। এই বার সেই সব ছবি বেছে বেছে করব, যেখানে সত্যিই মিউজিকের দরকার। সাউন্ডস্কেপের একটা জায়গা আছে। নয়তো না। আর নতুন ট্যালেন্টের
সঙ্গে সময় কাটাব। এটা একটা অন্য রকম পাওয়া। আমি কিন্তু অরিজিৎ সিংহ হোক, অন্তরা মিত্র হোক রিয়্যালিটি শো থেকেই এই সব ট্যালেন্ট খুঁজে পেয়েছি। তাই সিনেমা কম করে একটু ফ্রেশ ভয়েসের সঙ্গে থাকব ভাবছি।
নিজেও তো শো করছেন?
হ্যাঁ এখন শো করছি, এনজয় করছি।
‘দিলওয়ালে’ ছবিটা সুপারহিট হয়নি, কিন্তু এ ছবির প্রত্যেকটা গান সুপারহিট...
দেখুন ছবি বাজারে কম চলল, এই নিয়ে সব সময় নালিশ করা উচিত নয়। আমার গান আমার সন্তানের মতো। সে ভাবেই ওরা আমার মধ্যে বেড়ে ওঠে। দর্শকের ভাল লাগলে আমারও ভাল লাগবে। তবে আমি মনে করি ছবির গান আর ছবি সম্পূর্ণ দুটো ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ মাধ্যম। আজকের দিনে দুটো বিষয়কে আলাদা করেই দেখা উচিত বলে মনে হয়। ছবি ফ্লপ করলেও গান হিট হয়।
আপনি ছবির গানকে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ বলছেন কিন্তু শাহরুখ–কাজলয়ের রসায়ন না থাকলে ‘গেরুয়া’এত হিট হয় না।
ওহ! শাহরুখ–কাজল তো পাগল করা এক জুটি। আর আমি বিশেষ করে কাজলের খুব ভক্ত। তবে গান তৈরি করার সময় আমি এটা শাহরুখের গান, এটা রণবীরের গান এ ভাবে ভাবি না। ছবির ভাবনা অনুযায়ী কিন্তু গান তৈরি হয়।
অনুরাগ বসু ও প্রীতম
গান যদি সত্যি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ হয় তা হলে তো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রাইভেট অ্যালবামের এত আকাল পড়ত না। সোনু নিগম থেকে শ্রেয়া ঘোষাল এই মুহূর্তে কেউ প্রাইভেট অ্যালবাম করার কথা ভাবছেন না।
শ্রেয়া কিছু কাজ নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যস্ত। আর দেখুন প্রত্যেক শিল্পীর একটা সময় থাকে, তার পর ইন্ডাস্ট্রি ফ্রেশ ভয়েস খোঁজে। সোনু প্রচুর শো করছে এখন। ও হয়তো পারফর্ম্যান্সে বেশি জোর দিচ্ছে। আসলে প্রাইভেট অ্যালবামের প্যাকেজিং ঠিক মতো হয় না আজকাল। হলে তা নিশ্চয়ই চলবে। ‘হাওয়া হাওয়া’ চলেনি?
সে তো অনেক আগের কথা...
কেন? ঋত্বিকের ‘ধীরে ধীরে’ তো দারুণ চলেছে। প্রাইভেট অ্যালবাম সে ভাবে হচ্ছেই না তো!
বাংলায় রেডিয়োতে তো প্রাইভেট অ্যালবাম বাজানোই হয় না। লোকে করবে কেন?
সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু একটা কথা বুঝতে হবে আমি যখন মুম্বই এলাম তখন শঙ্করের ‘ব্রেথলেস’, ফাল্গুনী পাঠক, ইউফোরিয়ার বাজার। তখন কিন্তু ফিল্মের সাউন্ড
একদম আলাদা ছিল যেমন নাদিম শ্রাবণ, অনু মালিক, যতীন ললিত। ফিল্মের গান আর নন ফিল্ম গান একদম আলাদা হতে হবে। মিশে গেলেই মুশকিল। আগে হিন্দি ছবিতে কেউ রক ইউজ করত না আমি রক নিয়ে এলাম।
‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ তে?
হ্যাঁ। এই ছবিতে পুরো রকের ব্যবহার করেছি। আইডেনটিটি তৈরি করতে হবে। বোঝাতে হবে যে আমার মিউজিক আলাদা। ইউনিকনেস চাই। অরিজিৎ সিংহের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন মিকা সিংহের আছে আবার হানি সিংহের আছে।
লোকে তো বলে হানি সিংহ সুরে গান না। কী বলতে চান? এটাই ওর ইউনিকনেস?
শুনুন হানি সিংহের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। সেই জন্যই ও হিট। ওর ভয়েস আর স্টাইল সবটাই আলাদা। অন্য কারও মতো না। সোনু নিগম, রেখা ভরদ্বাজ এমনকী শ্রেয়া ঘোষাল সকলেই আলাদা। এই আলাদা হওয়ার জন্যই ওরা বিখ্যাত। বাংলায় যেমন কবীর সুমন। এখনও অনেক ভাল গান তৈরি হয়ে ইন্টারনেটে এসেই থেমে যাচ্ছে। এই সব অন্য ধারার গানকে আরও পুশ করতে হবে। গান গাইলেই হবে না। মার্কেটিংটাও একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আইটিউনস, ইউ টিউব চ্যানেলে তো যে কেউ গান রেকর্ড করে লোড করে দিচ্ছে...
এখন কত সুবিধে! ইউটিউবে কেউ ভাল গান রেকর্ড করে লোড করল, দেখা গেল তার জনপ্রিয়তা একটা হিন্দি গানের সমান হয়ে যাচ্ছে। ভাবুন, তাঁকে প্রোডিউসর-ডিরেক্টর কাউকে ধরতে হচ্ছে না। এখন ভাল গান করলে কত সহজে দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এরা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘সারেগামাপা’য়ের মতো রিয়্যালিটি শোয়ের খুব খুব দরকার কিন্তু। আমি ২৬ মার্চ নতুন ‘সারেগামাপা’ লঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক নতুন শিল্পীর গান শুনতে পাব।
রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিযোগীরা টেকে না কিন্তু...
দরকার নেই। রিয়্যালিটি শো করতে করতে যা তারা পাচ্ছে সেটাই অনেক। মুখ চেনা হয়ে যাচ্ছে। অনেক শো-য়ের ডাক আসছে। স্বপ্নও দেখছে।
সবাই কি পারবে স্বপ্নপূরণ করতে?
না সবাই পারবে না। গুজারা করনে কা প্রবলেম থা ও পুরা হো যাতা হ্যায়। আপনি জানেন এখন এমন রিয়্যালিটি শোয়ের সিঙ্গার আছে যারা আমার থেকেও বেশি টাকা করেছে।
কারা তাঁরা?
না, এখন তাঁদের নাম বললে মুশকিল আছে। কে কী ভাবে নেবে।
আচ্ছা অরিজিৎ সিংহ কাউকে ইন্টারভিউ দিতে চান না কেন?
কী জানি ও বোধহয় ওর ডিমান্ড বাড়ায়।(খুব হাসি)
বাঙালি হয়ে বাংলা ছবিতে কাজ করতে ইচ্ছে করে না?
খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কী মজা জানেন? আমি প্রচুর ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এক বছরে আমার সব ডেট ব্লক। তখনই বাংলা ছবির অফার এসেছে, করতে পারিনি।
কিন্তু লোকে বলে বাংলা ছবির বাজেটের জন্য আপনাকে অ্যাফোর্ড করা যায় না?
না। এটা ভুল। আমি নন্দিতাদির ( রায়) সঙ্গে কাজ করতে চাই। উনি আমার খুব কাছের মানুষ। পরিবারের মতো। ‘বেলাশেষে’ দেখে খুব ভাল লেগেছে আমার। অনিন্দ্য খুব বন্ধু। কৌশিকদা, সৃজিতের সঙ্গে কাজ করতে চাই। দেখি।