‘‘কেরিয়ারের শুরুর দিকেই অনেকটা ব্যর্থতা দেখে ফেলেছি।’’
বিদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এসে মডেলিংয়ে। অভিনেতা হয়ে স্বপ্নপূরণের ছুট। নেশা থেকে পেশা, তারকা জীবন থেকে ব্যক্তি জীবন, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম— মনের জানলা খুলে অকপট সোমরাজ মাইতি।
প্রশ্ন: ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় বড় লাফ। একসঙ্গে ছবিতে কাজ করছেন মুখ্য চরিত্রে। কেমন লাগছে?
সোমরাজ: বড় লাফ! (হাসি) আপাতত হাতে তিনটে ছবি। আমার কিন্তু বরাবরই ইচ্ছে ছিল অভিনয়ে আসব, বড় পর্দায় কাজ করব। ছোট পর্দায় আগে কাজ পেলাম। তার পরে সিরিজ। এখন ছবিতে ডাক পাচ্ছি। টানা ছ’বছর ধারাবাহিকে কাজ করার পরে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। মনে হয়, সব রকম পরিস্থিতিতেই কাজ করতে পারব।
প্রশ্ন: ‘জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি’ এবং ‘আম্রপালী’। একসঙ্গে দুটো বড় ছবি। কোনটা সোমরাজের বেশি কাছের?
সোমরাজ: দুটোই। ‘জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি’ অভিজিৎ গুহ- সুদেষ্ণা রায়ের ছবি। এই নিয়ে ওঁদের সঙ্গে তৃতীয় কাজ। স্বচ্ছন্দ তো বটেই। আর ‘আম্রপালী’র পরিচালক রাজা চন্দ। যে প্রতিযোগিতার হাত ধরে মডেলিংয়ের দুনিয়ায় প্রথম পা রাখার সুযোগ, রাজাদা ছিলেন তার এক জন বিচারক। সেই ২০১৪ থেকে পরিচয়। তাই দুটো ছবিতেই চেনা মানুষের, জানা পরিসরে কাজ। একটা কমেডি, অন্যটা ত্রিকোণ প্রেমের ছবি। মেজাজে আলাদা। তুলনা করার জায়গাতেই নেই।
প্রশ্ন: কিন্তু ‘আম্রপালী’-তে আপনার বিপরীতে আয়ুশী তালুকদার, আপনার বাস্তবের প্রেমিকা। তা-ও এ ছবি বেশি কাছের নয় বলছেন?
সোমরাজ: প্রেমটা ব্যক্তিগত জীবনে। কাজের জায়গায় আমরা সহকর্মী। ত্রিকোণ প্রেমের ছবিতে তৃতীয় জন বনি। আয়ুশী কিন্তু বনির সঙ্গে আগে কাজ করেছে। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার দু’জনে একসঙ্গে। সেখানে তো আমি নতুন! (হাসি) আর ‘জয় কালী’তে আমার বিপরীতে সুস্মিতা। ও-ও কিন্তু আমার ভাল বন্ধুই! প্রশ্ন: ছবিতে আপনি আর আয়ুশী ত্রিকোণ প্রেমের দুই চরিত্র। বাস্তবেও যদি তৃতীয় ব্যক্তি মাঝখানে ঢুকে পড়ে?
সোমরাজ: ওরে বাবা! আমিই পালাব! আমি খুব একমুখী আর বিশ্বাসে গাঁথা সম্পর্কে চলতে পছন্দ করি। তাতে কোথাও নড়চড় হলে কিংবা বিশ্বাসে ফাটল ধরলে আমি নেই। কারও সঙ্গে সম্পর্ক হলে সেটা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দু’জনেরই। তার পরে কোনও এক জনের অন্য কাউকে ভাল লাগতে পারে, দু’জনের পথ আলাদা হয়ে যেতেই পারে। তাতে তো কোনও অপরাধ নেই।
আয়ুশীর সঙ্গে সোমরাজ।
প্রশ্ন: আপনাদের সম্পর্কটা কত দিনের?
সোমরাজ: অভিনয়ে আসার আগে থেকেই আমাদের আলাপ। প্রেম হল এক ধারাবাহিকের জন্য একসঙ্গে অডিশন দিতে গিয়ে। তার পরে ভালবেসে টানা ছ’বছর দু’জনেই সেই সম্পর্কেই বাঁধা পড়ে আছি। আমার জীবনে এ পর্যন্ত কঠিনতম সময়টায় ও আমার পাশে ছিল। সেই সময়টায় আমরা একে অন্যকে আরও বেশি করে চিনেছি, বুঝেছি। সম্পর্কটা খাঁটি হয়েছে।
প্রশ্ন: সুপুরুষ। অভিনয়ের জগতে ছ’বছর পার করে ফেলেছেন। অথচ আপনাকে নিয়ে কোনও রটনা, ট্রোলিংও নেই! কী করে?
সোমরাজ: আমি খুব বোরিং মানুষ! তাই বোধহয়! (হাসি) আসলে প্রেম করি, সেই সম্পর্কটা যত্নে টিকিয়ে চলেছি। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে নিজেকে, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে দূরে রাখি সচেতন ভাবেই। দেখেছি, সহ-অভিনেতাদের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধুত্ব হয় কলাকুশলীদের সঙ্গে। এক-একটা ধারাবাহিকে কাজ শেষের পরে প্রাক্তন সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও ফিকে হয়ে যায়। আমায় নিয়ে চর্চার মতো মালমশলা নেই তো! আর সুপুরুষ! জানেন, কত ছবি, ধারাবাহিকে কাজের সুযোগ মেলেনি ‘বাচ্চা বাচ্চা’ মুখ বলে?
প্রশ্ন: এখন তো ছবিতে ডাক পাচ্ছেন। তা হলে কি বড় হয়ে গেলেন?
সোমরাজ: হ্যাঁ, জিমে গিয়ে এখন নিয়মিত শরীরচর্চা করি। বাচ্চা ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। সেই পরিশ্রমেরই সুফল! (হাসি) আসলে কেরিয়ারের শুরুর দিকেই অনেকটা ব্যর্থতা দেখে ফেলেছি। তাই সেখান থেকে নিজেকেই নিজে তুলে আনছি। নিজেকে ঘষামাজা করে তৈরি করছি। অভিনয়ে নিজের ভুলভ্রান্তিগুলোয় নজর দিয়ে খামতিগুলো মেটানোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: ‘এই ছেলেটা ভেলভেলেটা’ আপনাকে ঘরে ঘরে পরিচিত মুখ করে তুলেছিল। তার পরে ব্যর্থতা এল কী ভাবে?
সোমরাজ: এর উত্তর আমারও অজানা! ছোট পর্দায় যতগুলো কাজ করেছি, সবক’টিই জনপ্রিয় লেখক-পরিচালকদের ধারাবাহিক। সেই সময়ে সেই প্রত্যেক লেখক-পরিচালকের অন্য সব ধারাবাহিকই হইহই করে চলেছে। অথচ ‘এই ছেলেটা ভেলভেলেটা’ বাদ দিয়ে কোনওটাই দর্শকদের তেমন পছন্দসই হল না। কেন কে জানে! অথচ গল্প ভাল ছিল, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, মুখ্যচরিত্র হিসেবে আমার অভিনয় অনেকেরই খারাপ লাগেনি। তবু কেন যে রেটিং তালিকায় সে ভাবে দাগ কাটতে পারল না!
‘‘প্রেম করি, সেই সম্পর্কটা যত্নে টিকিয়ে চলেছি।’’
প্রশ্ন: হতাশা আসেনি?
সোমরাজ: আসেনি আবার! পরপর ধারাবাহিক দর্শকের মন ছুঁতে ব্যর্থ। বড় পর্দায় যেতে চাইছি, ডাক আসছে না। মনে হত, সব ছেড়েছুড়ে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাই। মানে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে যে সব চাকরিতে যাওয়া যায়, তেমন কিছুতে। তার পরে এল করোনা আর লকডাউন। টানা কাজ নেই। তখন বাবা, মা আর আয়ুশী পাশে দাঁড়িয়েছিল। লাগাতার মনের জোর আর সাহস জুগিয়ে গিয়েছে ওরাই। কিন্তু এই লকডাউনের সময়টাকেই কাজে লাগিয়েছি ঘুরে দাঁড়াতে। নিজেকে আরও ভাল করে তৈরি করেছি। অভিনয়ের স্বপ্ন তো আমার আজকের নয়!
প্রশ্ন: বিদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন। একেবারে অন্য পেশার মানুষ হওয়ার কথা ছিল। অভিনয়ের শখ হল কী ভাবে?
সোমরাজ: ওই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়টাই কিন্তু আমায় অভিনয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বিদেশে একা একা থাকতাম। নিজের দেশ, বাঙালি জীবনের ছোট্ট ছোট্ট জিনিসগুলোর বড্ড অভাব বোধ করতাম। সে জন্যই তখন প্রচুর বাংলা ছবি দেখতাম। ক্লাসিক, মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি, অন্য ঘরানার ছবি— সব রকমই। বাণিজ্যিক ছবিতে সবচেয়ে বেশি টানত গানগুলো। দেব, জিৎ, অঙ্কুশদের এক একটা গান চালিয়ে ওয়েবক্যামের সামনে নাচতাম। একদম ছবির দৃশ্যগুলোর অনুকরণে! সেখান থেকেই কিন্তু অভিনয়ে আসার শখটা মাথাচাড়া দিয়েছিল! তখন থেকেই নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু! অবশ্য ছোট পর্দা, সিরিজ হয়ে ছ-ছ’টা বছর লেগে গেল বড় পর্দায় পৌঁছতে।
প্রশ্ন: কে বেশি ভাল নাচত? আপনি? না দেব-জিৎ-সোহমরা?
সোমরাজ: (হা হা হাসি) নিজের নাচ কিন্তু এক্কেবারে নিখুঁত মনে হত! নিজেই নিজের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম! তখন থেকেই এক এক করে পরিচালক-অভিনেতা-প্রযোজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ চাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। তার পরে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় ফিরে মডেলিংয়ের প্রতিযোগিতা। জিতেও ফেললাম। তার পর মডেলিং করতে করতে একটু একটু করে এগিয়েছি অভিনয়ের দিকে। একেবারে পরিকল্পনা করে।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও কি সোমরাজ এতটাই গোছানো? এ ভাবেই পরিকল্পনা করে চলেন?
সোমরাজ: চেষ্টা করি অন্তত। নিজের জীবনটাকে যত্ন করে গুছিয়ে নিতে কে না চায়! একটা সম্পর্কে রয়েছি। সেটাকে পূর্ণতা দিতেও চাই আগামীতে।
প্রশ্ন: বিয়েটা কবে করছেন?
সোমরাজ: অ-নে-ক দেরি! অন্তত পাঁচ বছর। আসলে ধারাবাহিকের ব্যর্থতা এবং লকডাউনের পরে আবার শূন্য থেকে শুরু করেছি। আয়ুশীও তাই। নিজেদের একটু গুছিয়ে, আর্থিক দিক থেকে আরও একটু স্থিতিশীল হয়ে, তার পরেই বিয়ের মতো একটা বড় পদক্ষেপ করা ভাল। তাই নয় কি?