শুরু করেছিলেন নায়ক হয়ে। তার পর নায়কের ভাই। ইদানীং খলনায়ক। সব রকম চরিত্রেই ধারাবাহিকে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। কেন এমন উলটপুরাণে চলছেন রাজীব বসু? ছোটপর্দার জীবন থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ— সব নিয়েই অকপট অভিনেতা। মনের দরজা হাটখোলা করলেন আনন্দবাজার অনলাইনে।
ছোট পর্দার পরিচিত মুখ রাজীব।
নায়ক হয়ে শুরু। এখন নায়িকাকে ব্যতিব্যস্ত করা খলনায়ক। বেশ কয়েক বছর ধরেই ছোট পর্দার চেনা মুখ রাজীব বসু। টলিউডের হালচাল, পর্দার দিনযাপন থেকে ব্যক্তি রাজীবের ভাল লাগা, মন্দ লাগা— সবটাই মেলে ধরলেন আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে।
প্রশ্ন: নায়ক হয়ে শুরু করেছিলেন, এখন পার্শ্ব চরিত্রে। আফশোস হয় না?
রাজীব: একদম না। এটা তো নিজের পছন্দ আর সিদ্ধান্তেই বেছে নেওয়া।
প্রশ্ন: সে কী, কেন? লোকে তো উল্টোটা করে!
রাজীব: আসলে গল্পের নায়ক বা মুখ্য চরিত্রে থাকা মানে অন্তত দেড় বছর এক ধারাবাহিকে আটকে যাওয়া। কনট্র্যাক্টে থাকলে অন্য কিছুতে কাজ করা সম্ভব হয় না। ছবি বা সিরিজের জন্য সময় বার করাটাও কঠিন হয়ে যায়। পার্শ্ব চরিত্রে কাজ করলে এই দুটোরই পথ খোলা। হইচইয়ে যেমন একটা সিরিজ করলাম। ক’দিন আগে ‘সুইৎজারল্যান্ড’ ছবিতে কাজ করলাম। তা ছাড়া, পছন্দ মতো একাধিক ধারাবাহিকের চরিত্রে কাজ করা বা নিজের শখ পূরণের সুযোগও থাকে। সে কারণেই মুখ্য চরিত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে এই ধরনের চরিত্রগুলো বেছে নিই।
প্রশ্ন: কী কী শখ আহ্লাদ মেটান?
রাজীব: ক্রিকেট। আমি তো ক্রিকেটই খেলতাম। ফুটবলও। ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে এমন একটা চোট লাগে যে আমার ক্রিকেট জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তখনকার মতো ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কারণ আমি দৌড়োতে পারতাম না। শ্যুটিংয়ে ওই ধরনের শট দিতেও সমস্যা হত। তার পরে অপারেশন হয়েছে, সুস্থ হয়েছি। এখন অনেক বছর পেরিয়ে আবার খেলি মাঝেমধ্যেই। টলিউড ইন্ডাস্ট্রির নানা রকম লিগ ম্যাচগুলোয় অংশ নিই। আর পরিবারকে সময় দেওয়া তো আছেই।
প্রশ্ন: ভাল ছেলের চরিত্র থেকে ‘দুষ্টু লোক। কেমন লাগছে?
রাজীব: সত্যি বলব? বেশ লাগছে। অন্য রকম। আসলে সুশান্তদা (প্রযোজক সুশান্ত দাস) আমায় গল্পের ভিলেন হতে বলেছিলেন 'জয়ী'তে। আমি রাজি হইনি তখন। শেষমেশ ‘কৃষ্ণকলি’তে প্রথম খল চরিত্রে কাজ করলাম। এ বার ‘গ্রামের রানি বীণাপাণি’তে। ‘লক্ষ্মীকাকিমা সুপারস্টার’-এর চরিত্রেও গ্রে শেড আছে। এত দিনে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। নেতিবাচক চরিত্রে এমনিই অনেক শেড থাকে। অভিনয়ের সুযোগও বেশি, তৃপ্তিও। তার জন্য সুশান্তদার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওঁর প্রযোজনাতেই পরপর ধারাবাহিকে আমি বহু বছর ধরে কাজ করছি।
স্ত্রী মোহিনী ও ছেলে রোহনের সঙ্গে রাজীব।
প্রশ্ন: এক দিনে দুটো ধারাবাহিকে দু’রকম চরিত্র হলে?
রাজীব: হয়েছিল তো! ‘ইরাবতীর চুপকথা’য় অভীক ভীষণ ভাল ছেলে আর ‘কৃষ্ণকলি’তে খল চরিত্র। রোজ একসঙ্গেই দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছি। সুইচ অন সুইচ অফ করতে হত। এক সেট থেকে অন্য সেটে যাওয়ার পথে ভাবনার গতিপথ পাল্টে নিতাম। ‘কৃষ্ণকলি’তে প্রথম ভিলেনের চরিত্র। প্রথম প্রথম কাজটা শক্ত ছিল। তাই ভীষণ মনোযোগ দিয়ে সিন পড়ে আলোচনা করে তৈরি হতাম। ‘ইরাবতী’ সেখানে মনের মতো, শ্যুটিংয়ে আড্ডা-মজা। ওখানে আলাদা করে অভিনয়ের দরকার পড়েনি।
প্রশ্ন: রাজীবকে এ ভাবে পাল্টে যেতে দেখে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন?
রাজীব: ও বাবা, দর্শকরা রেগে গিয়েছিলেন তো। অনেকেই বলতেন, ভাল লাগছে না। আর আমার মা তো আমায় খারাপ মানুষের চরিত্রে দেখলেই রেগে যায় খুব। ছেলে গল্পের নায়ক বা নায়িকার শত্রু, এটা বুঝলেই মা টিভির সামনে থেকে সটান উঠে পড়ে! (হাসি) রোজ বলে, ভাল চরিত্র কর, একদম খারাপ চরিত্র করবি না! সাধারণ দর্শক আমায় নায়ক বা ভাইয়ের মিষ্টি মিষ্টি চরিত্রে ভালবেসেছেন। এখন খল বা ধূসর চরিত্রেও বোধহয় খুব একটা অপছন্দ করছেন না। তেমনই শুনছি অন্তত।
প্রশ্ন: ভিলেন হতে দেখলে মা রাগ করেন। প্রেম করতে দেখলে বউ চটে যান না তো?
রাজীব: (হা হা হাসি) যেত কিন্তু সত্যিই! বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে। টলিউডের শুরুর ওই সময়, প্রথম প্রথম প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারতাম বউয়ের মুখ ভার। বিয়ের আগে যখন প্রেম করছি, তখন তো এই ভয়েই অডিশন দিতে যেতাম না! যদি সম্পর্কটা ভেঙে যায়! তবে আস্তে আস্তে মোহিনী সবটা বুঝতে পেরেছে। বুঝেছে পর্দায় যা দেখায় তা পুরোটাই নকল। সবটাই অভিনয়। লোকে যেমন চাকরি করে, এটাও স্রেফ আমাদের পেশার অংশ। এখন তো ও-ই আমায় ঠেলে কাজে পাঠায়!
প্রশ্ন: ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন, অভিনয়ে এলেন কী ভাবে?
রাজীব: মায়ের জন্যই আসা হল টলিউডে। ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে মডেলিং করতাম। তখন মা খুব চাইতেন আমি অভিনয় করি। আমি তখন চাকরি করি পার্ক স্ট্রিটে। সে সময়ে অডিশনে ডাক আসতে শুরু করল। হঠাৎই ২০০৯-এ ‘লুকোচুরি’ ধারাবাহিকে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব! আমি তো হাঁ। এর পরে ‘মেঘের পালক’, ‘মা’। পর পর ধারাবাহিক করতে করতেই এক দিন মনে হল, মুখ্য চরিত্রে কাজ করতে গেলে একটা ধারাবাহিকেই আটকে যাচ্ছি। তার পরেই সরে এলাম পার্শ্ব চরিত্রে। তবে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘তুমি রবে নীরবে’, ‘জয়ী’, ‘কুঞ্জছায়া’, ‘তিতলি’-সহ এ পর্যন্ত সব ধারাবাহিকেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তোলা ছিল আমার জন্য। সে জন্যও আমি কৃতজ্ঞ প্রযোজক-পরিচালকদের কাছে।
প্রশ্ন: বাস্তবের রাজীবের সঙ্গে কোন চরিত্রটার মিল আছে?
রাজীব: ‘জয়ী’তে যে চরিত্রটা ছিল, অগ্নি, সে ওর ভাসুর, ফুটবল কোচও বটে। আবার জয়ী যখন খেলা ছেড়ে দিতে চাইল, সে-ই ওকে উদ্বুদ্ধ করল ফুটবলে ফিরতে। অগ্নি নিজে ফুটবল খেলত, পরে কোচ। খুব মেলাতে পারতাম নিজেকে ওই চরিত্রটার সঙ্গে। বাস্তবে আমি ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি, কোচিং ও করিয়েছি। তা ছাড়া, ‘তিতলি’তে আমি ছিলাম নায়কের বড় দাদা। আমার নিজেরও দাদা আছে। তবে পর্দায় যেমনই হই, বাস্তবে আমি বেশ চুপচাপ, নিজের মতো থাকি। কথা বলি, গল্পও করি, তবে কম। আসলে সম্পর্কটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছলে খুব বেশি আড্ডা, হাহা-হিহিও করে উঠতে পারি না। টিম ভাল হলে অবশ্য আলাদা কথা। ‘ইরাবতী’তে আমাদের সবার যেমন দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এখন ‘বীণাপাণি’র সেটেও ভালই লাগে বেশ।
প্রশ্ন: ইদানীং আপনাকে রিয়্যালিটি শো-এ দেখা যায় মাঝে মধ্যেই। পছন্দ করেন?
রাজীব: হ্যাঁ, ভালই লাগে। দর্শক পর্দার রাজীবের বাইরে ব্যক্তি আমিকে চিনতে পারে। আমার জীবনযাপন, ভাল লাগা-মন্দ লাগাগুলো বুঝতে পারে। তাতে নিশ্চয়ই পর্দায় আমার করা চরিত্রগুলোর প্রতি একটা আকর্ষণ বা অনুভূতি তৈরি হয়।
প্রশ্ন: প্রায় তেরো বছর ইন্ডাস্ট্রিতে। বদল দেখলেন কিছু?
রাজীব: হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারি কখন বাড়ি যেতে পারব! (হাসি) আসলে এখন তো শ্যুটিংয়ের সময়টা চোদ্দো ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই দিনের কাজ কখন শেষ হবে, তার পরে অন্য কিছু করতে পারব কি না, সে ধারণাটা মোটামুটি পাওয়া যায় যায়। ফলে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সময় দেওয়া কিংবা নিজস্ব কোনও কাজ করার সময় বার করে নিতে পারি এখন। আগে অনেক সময়েই সারা রাত শ্যুটিং হত। ইন্ডাস্ট্রির নিয়মকানুন পাল্টেছে এখন। তা ছাড়া, কোভিডের পরে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে।
প্রশ্ন: ইদানীং তারকারা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকেন খুবই। আপনি?
রাজীব: এই, আমি এখনও রিল বানাতে পারি না! ফেসবুকে থাকি বটে, তবে ওই নিজের কাজ, ভাল কোনও ছবি বা খেলাধুলো নিয়ে পোস্ট। ব্যস! তবে এখন মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও সক্রিয় থাকা জরুরি। তাই থাকব ভাবছি এ বার থেকে।
প্রশ্ন: এত বছর টলিউডে। কারও প্রেমে পড়েননি?
রাজীব: পাগল নাকি! টলিউডের প্রেম আর তার চর্চা থেকে আমি সাড়ে সতেরো হাত দূরে! সত্যি বলতে কি, ছেলে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, এ রকম নালিশ আমার মা-বাবাকে কখনওই শুনতে হয়নি! জীবনে প্রেম এক বারই করেছি। তাকেই বিয়ে করেছি বারো বছর আগে।
প্রশ্ন: এখন যদি জনপ্রিয় কোনও অভিনেত্রী প্রেমের প্রস্তাব দেন?
রাজীব: বলব, অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমরা বন্ধুই থাকি প্লিজ?