বর্তমান পরিস্থিতিতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকেই ছবি মুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন প্রসেনজিৎ। 'নিরন্তর'-এর একটি দৃশ্য।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রতিকূলতার মধ্যেই উত্তরবঙ্গে সফরে যাচ্ছেন, তুমুল হট্টগোল তাই নিয়ে...।
প্রসেনজিৎ: (হাসি) আমার কানেও এসেছে। এতখানি হইহই হবে, আন্দাজ করতে পারিনি। আমি তো ‘নিরন্তর’-এর টিজার বা পোস্টার নিজে কাউকে কোথাও পাঠাইনি। কিন্তু দেখলাম সুজিত থেকে সুজয়, টনি (অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী), সৃজিত— সবাই ছবি নিয়ে ভাল লাগার কথা জানিয়েছে।
সবাই বড় পর্দায় ছবি মুক্তির জন্য আঁকুপাঁকু করছে আর আপনি ‘নিরন্তর’ নিয়ে আসছেন ওটিটি-তে। কেন?
প্রসেনজিৎ: গত ডিসেম্বর থেকে জি৫ ওয়েব প্ল্যাটফর্ম কিনে রেখেছে আমার এই ছবি। সঙ্গে সঙ্গে রিলিজ হয়নি কারণ, একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানোর পরিকল্পনা আগেই ছিল। ‘নিরন্তর’ সেখানেও ভাল সাড়া ফেলেছে। আর হলে মুক্তি পাওয়ার মতো ছবি এটা নয়। একদমই ভিন্ন স্বাদের। বর্তমানে লকডাউন যে ভাবে বাড়ছে তাতে আর কত দিনই বা ফেলে রাখতে বলব? ফলে, এখন ওটিটি-ই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক এবং অদ্বিতীয় আশ্রয়। ডিসেম্বরে যে ছবি সেন্সর পেয়ে যায় তাকে খামোখা আর আটকানোর মানে আছে?
নিরন্তর একটি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র, মনে করেন প্রসেনজিৎ। ছবির একটি দৃশ্য।
ওটিটি-তে ছবি মুক্তির নেপথ্যে এই একটাই কারণ?
প্রসেনজিৎ: (আবার হাসি) আরও একটা কারণ আছে। গত বছরের মে-জুন মাসে শেষ ছবি মুক্তি পেয়েছে আমার। আমাকে তো আবার দশর্কদের সামনে আসতে হবে। অভিনেতা হিসেবে আমার খিদে তো আছেই। কোনও না কোনও উপায়ে কাজ করে যেতেই হবে। ওটিটি-ই না হয় আপাতত সেই জায়গা নিল। হয়তো প্রফিট ততটা হবে না... তবু...।
আরও পড়ুন: এ বার গুরুগ্রাম কাঁপাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল, এগোচ্ছে দিল্লির দিকে
লোকসানের মুখ দেখতে হলেও হতে পারে?
প্রসেনজিৎ: এটা মানতেই হবে, বড় পর্দা আর ওটিটি কখনওই এক নয়। সেটা বলিউডও দেখছে, আমরাও বুঝছি। যদিও বলিউড আর টলিউডের সমীকরণ আলাদা।
অ্যামাজনে ‘গুলাবো সিতাবো’ ভাল চলেনি। বাংলা ছবি লোকে দেখবে?
প্রসেনজিৎ: আমার ধারণা ‘বুলবুল’ লোকে বেশি দেখবে। এ ভাবেই কোনওটা লোকে কম দেখবে কোনওটা বেশি। কিন্তু দেখবে। ‘নিরন্তর’-এর দিক থেকেও আমার সেই ভাবনা কাজ করেছে। ভাবনা দুই, এই মুহূর্তে ‘হইচই’ ছাড়া বাংলায় আর কোনও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেই। নেটফ্লিক্স, হটস্টার, অ্যামাজন, ডিজনি স্টার— সবাই হিন্দি, তামিল, তেলুগু ছবি কিনতে বা দেখাতে চায়। বাংলা সেই অর্থে ওরা নেয় না। নিলেও হয়তো হাতে গোনা কিছু ছবি নেয়। সেখানেও বিশেষ সমীকরণ কাজ করে। হাতে অপশন কম থাকায় আমরা তাই হইচই, আড্ডা টাইমস বা জি৫ ওয়েব প্ল্যাটফর্মকেই বাছব। কারণ, আমাদের টিকে থাকতে হবে। যেমন, বাংলায় ছোটপর্দা মারাত্মক শক্তিশালী। ঠিক সে রকমই আগামী পাঁচ বছরে ছবি মুক্তির ক্ষেত্রে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিশাল জায়গা নেবে, আমার বিশ্বাস।
আরও পড়ুন: যে আশাকে স্বামী ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছিলেন, রাহুল তাঁকেই গ্রহণ করেছিলেন পরম আদরে
'নিরন্তর'-এর একটি দৃশ্য।
বিশ্বাসের কারণ?
প্রসেনজিৎ: কারণ, সিনেমার আয়ু দু’ঘণ্টা। কিন্তু কোনও সিরিজ ভাল লেগে গেলে মানুষ ভেঙে ভেঙে বারে বারে দেখেন। যদিও বড়পর্দার বিকল্প বড়পর্দা নিজেই। সিনেমা হল থাকবে। লোকে দেখতেও যাবেন। তার মধ্যেও বলব, মানুষকে দুটো তিনটে লেন, মেনস্ট্রিমকে ভেঙে অন্য রাস্তা, দরকারে গলিপথ খুঁজে নিতে হবে। আগামী দিনে টিকে থাকতে গেলে এখন থেকেই বুঝতে হবে, সব সিনেমাই হল-মুক্তির জন্য নয়। মান বুঝে ছবি হলে মুক্তি পাবে না ওটিটি-তে? সেটা আগে বুঝে নিতে হবে।
আপনার যুক্তিতেই ‘নিরন্তর’ ওয়েব প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার মতো ছবি?
প্রসেনজিৎ: একদমই তাই। ‘কাকাবাবু’র মতো ছবি বড় পর্দায় যে ছাপ ফেলবে সেটা এই ছবি থেকে আশা করাই বৃথা! এই চিন্তাভাবনা করে আগামী দিনে এগোতে হবে। আর সেই অনুযায়ী ব্যবসায়িক ছক তৈরি করতে হবে। সাফল্য আসতে বাধ্য। ছোট্ট উদাহরণ দিই? ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘কেদারা’ বা আমার-অতনু ঘোষের ‘রোববার’ হলে প্রচুর দর্শক টানতে পারেনি। কিন্তু হইচই-তে আসতেই লোকে হইহই করে দেখেছে। ঠিকমতো প্রচার করতে পারলে দর্শক দেখবেই। যেমন, ‘গুমনামী’র প্রচার অ্যামাজন এমন দুর্দান্ত করেছিল যে লোকে বড়পর্দার পর মোবাইলেও হামলে পড়ে দেখেছিল।
দেখার পরিমাণ আর ব্যবসায়িক সাফল্য সমান হচ্ছে?
প্রসেনজিৎ: দর্শকের পরিমাণ আর কাউন্টিংয়ের পরিমাণ এখনও এক হয়নি। তাই, এখনও নেটফ্লিক্সে বাংলা ছবির চাহিদা নেই। সেই জায়গা নিয়েছে হইচই প্ল্যাটফর্ম। বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা যাঁদের পছন্দ তাঁদের প্রথম এবং শেষ পছন্দ এই প্ল্যাটফর্ম। কারণ, এখানে উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিৎ রায় হয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, জিৎ সবাই আছেন।
অন্য ধাঁচের ছবি হিসেবেও ‘নিরন্তর’ চর্চায়। ইউএসপি কী?
প্রসেনজিৎ: শুধুই বাণিজ্যিক সাফল্য মাথায় রেখে এই ছবি বানানো হয়নি। এই ছবিতে গল্পের বুনন টাটকা। অভিনেতারাও। এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমি করতে ভালবাসি। ৩৫ বছর কাজের পর যদি শুধুই ব্যবসায়িক সাফল্য মাথায় রাখতে হয় তা হলে কী করলাম! এখনও এক্সপেরিমেন্ট করব না? নতুন পরিচালক চন্দ্রাশিসও আরও একটা কারণ। ওর ছোট ছবি দেখেছি। আমার সঙ্গে সব সময় নতুন পরিচালকের যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। এক বার ওকে বলেছিলাম, নতুন কিছু কর, দেখি। এই কথাটা বললে সাধারণত পরের দিনই পরিচালকেরা নতুন চিত্রনাট্য নিয়ে চলে আসেন। চন্দ্রাশিস ব্যতিক্রম। দু’বছর পরে ‘নিরন্তর’-এর স্ক্রিপ্ট এনে বলেছিল, জানি তোমার পছন্দ হবে না। তবুও দ্যাখো...। আগ্রহ জাগল, চিত্রনাট্য শোনাতে বললাম। শুনতে শুনতে মনে হল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ছবি, অথচ সেখানে চেনা প্রসেনজিৎ নেই। চেনা মোড়ক নেই। একদম অন্য ট্রিটমেন্ট। যা এই প্রজন্মকে ধাক্কা দেবে। এগুলোই ইউএসপি।
ইতিবাচক ফল আশা করছেন?
প্রসেনজিৎ: করছি। নিডাস প্রোডাকশন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রাশিস-সহ টিম ‘নিরন্তর’-এর অনেক কষ্ট করে বানানো একটা ভাল ছবি। দর্শক সব পাবেন এতে, অন্য স্টাইলে। ডিজিটালি প্রিমিয়ার হওয়ায় ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও ভাল কোনও প্ল্যাটফর্মে রিলিজের চেষ্টা করব। আপাতত ছবি ঘিরে এটাই আমার ভাবনা এবং স্বপ্ন। আরও একটা কথা বলি, প্রতি বার ছবি মুক্তির আগে ট্রেলর, টিজার, বলিউড, টলিউডের সমস্ত পরিচালককে পাঠাই। এ বার সেটা করিনি। তাতে দেখলাম, সুজয়, সুজিত, সৃজিত, অতনু সবাই একজোটে নিজেদের মতো করে এই ছবির প্রচারে নেমে পড়েছেন। এটাই ভরসা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ছবির গল্প?
প্রসেনজিৎ: (হালকা হাসি) বলে দিলে কেউ কি দেখবেন? এটুকু বলতে পারি, সপরিবার দেখার মতো ছবি। মানুষের জীবনে প্রকৃতি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা দেখাবে এই ছবি। আর আছে জেনারেশন গ্যাপ। দুই প্রজন্মের দু’জন মানুষ এমন একটি জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যেখানে সোশ্যাল মাধ্যম কাজ করে না। আগের প্রজন্মের কাছে এটা কোনও ঘটনাই নয়। পরের প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া থাকতে পারে না। কী হবে এই দুটো মানুষের মধ্যে? সেই মজাই এই ছবির কেন্দ্রে। মাত্র পাঁচ দিনে কী করে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটাও দেখাবে ‘নিরন্তর’।
এই মুহূর্তে টেলিপাড়ার শুটিং শুরু হলেও টলিপাড়ায় নয়। এ দিকে ইন্ডাস্ট্রির হাতে রেডিমেড ৪০টি ছবি। সেগুলোর মুক্তির জন্য সবাই কি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দেখানো নতুন পথে হাঁটবেন?
প্রসেনজিৎ: কী বলি? এই পথ দেখানো বলতে পারি না আমি। পুরোটাই নির্ভর করবে প্রযোজক এবং ছবির মানের ওপর। নিশ্চয়ই ওঁরাও কিছু ভাবছেন। করোনা, লকডাউন নয়, আস্তে আস্তে বাংলা ছবির ব্যবসায়িক গ্রাফ যা দাঁড়াচ্ছে তাতে এটা বলতে পারি বিকল্প পথ খোঁজার সময় এসেছে। অতিমারির আগেও যে দর্শক হলে এসে চুটিয়ে সিনেমা দেখেছেন তা নয়। কিছু অবশ্যই দেখেছেন হলে। কিছু ওটিটি-তে। কিছু ছোটপর্দায়। সেগুলো বিশ্লেষণ করে কোন ছবি কোথায় রিলিজ করালে ভাল ব্যবসা দেবে সেটা এখনই ভাবার উপযুক্ত সময়। সঙ্গে বাজেটটাও বুঝেসুঝে। কারণ, দিনের শেষে সবার একটাই চিন্তা, ঘরে টাকা আসবে তো?
ছবি, ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি নিয়ে যখন ভাবার সময়, তখন ‘স্বজনপোষণ’ শব্দের ধাক্কায় পুরো টলিপাড়াই খান খান...!
প্রসেনজিৎ: নো কমেন্টস। আসলে, সময়টা ভীষণ স্পর্শকাতর। মানুষের মনও তাই-ই। ফলে, সামান্য কথা গায়ে আঁচড় কাটছে। অল্পেই সবাই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। আমরা কেউই ভাল নেই। আগামী দিনে কী হবে? কেউ জানি না। এই চাপটাও কম নয়।