উৎপল দত্তের জন্মদিনে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
আমি ব্যক্তি উৎপল দত্ত সম্পর্কে খুব কম জানি। কম জানি কারণ, ওঁকে খুব কম দেখেছি। দেখেছি, উৎপলবাবু কখনও একটু রসিকতা করছেন, নিজে খুব বড় কমিউনিস্ট— এ কথাটা জোর দিয়ে বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, আবার খুব ভাল অভিনয়ও করছেন। আমার দেখা বলতে এই। সামান্য এই অভিজ্ঞতা দিয়ে কি কোনও মানুষকে নিয়ে সবিস্তার লেখা যায়? তবুও যেটুকু স্মৃতির পাতায় উঁকি দিচ্ছে তা তুলে ধরছি আনন্দবাজার ডট কমের পাতায়।
‘নিজে খুব বড় কমিউনিস্ট— এ কথাটা জোর দিয়ে বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন উৎপল দত্ত’, এ কথাটি কেন বললাম? কেন ওঁকে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয়েছে? উৎপলবাবু কি তা হলে বামপন্থী ছিলেন না?
আমার পাল্টা মত, এমনও তো হতে পারে, উৎপলবাবু বামপন্থী নন, সেটাই বাকিরা ভাবতেন হয়তো! সেই কারণেই হয়তো ওঁকে বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হত। তার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
কোন পদক্ষেপ বা আচরণের কারণে তাঁকে নিরন্তর প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হত?
এর নেপথ্যে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোন ভাবনা থেকে তিনি এই আচরণ করতেন, তা নিয়ে আমার একটা অনুমান রয়েছে। উনি নিজেকে কমিউনিস্ট বলতেন। একই সঙ্গে তিনি অভিনয়টাও খুব ভাল পারতেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি তো খুব খারাপ কাজও করতেন! তাতে দেশের কোনও উপকার হত না। একটু ছ্যাবলামি, হাসি— আমরা শুধু হাসতাম। সেই কাজ দেখে কিন্তু আমরা কোথাও উত্তীর্ণ হতাম না। সেই জন্যই হয়তো নিজেকে জোর করে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। হয়তো ও ভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করতেন কিংবা প্রায়শ্চিত্তের মতো কিছু।
এ ক্ষেত্রে আরও একটি বক্তব্য রয়েছে। মানুষ মাত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। একই মানুষের মধ্যে একটা কৌতুক আর একটা ট্র্যাজিক চরিত্র কিংবা লঘু চিত্ত আর কমিউনিস্টের সহাবস্থান করাতে গেলে একটু অসুবিধা হয়ে যায় আর কি। তখন যাঁরা দেখেন, শোনেন, যাঁরা পছন্দ করতে চান— তাঁদেরও একটু অসুবিধা হয়। ওই মানুষটিরও সম্যক স্ফুরণ হয় না। উৎপল দত্তের সম্ভবত এই সমস্যাও ছিল।
এ বার আপনাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হবে, আমার কি ‘কৌতুকাভিনেতা’ উৎপত্ত দত্তকে নিয়ে ক্ষোভ আছে?
আমি বলতে চেয়েছি, উনি যদি সেগুলোর দিকে মন না দিতেন, যদি তদ্গত হয়ে যেগুলো পারেন সেগুলোকেই আরও বেশি করে করতেন তা হলে আমাদের এবং ওঁর— সকলেরই আরও বেশি করে উপকার হত। আদতে এ ভাবে উৎপলবাবু নিজেকে অপচয় করেছেন। নিজের প্রতিভার ভুল ব্যবহার করেছেন। আরও দামি কাজ করতে পারতেন, আমরা সেই সব থেকে বঞ্চিত হলাম। যদিও সম্পূর্ণ দোষ ওঁর-ও নয়। একটা মানুষ যখন কিছু করতে পারে, সেটা দিয়েই সে তখন বাকিদের আমোদিত করতে চায়। অনেকে তাকে পছন্দ করুন, সেই চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। উৎপলবাবু হয়তো সেটাই চাইতেন। অনেকে বলবেন, উপার্জনটাও বড় ব্যাপার। আমি বলব, পৃথিবীতে এটা সবচেয়ে খারাপ যুক্তি! এই যুক্তি দিয়ে মানুষ মানুষকে খুন করে। একজন মানুষের পেট কতটুকু?
প্রকৃত সত্য হল, কৌতুকাভিনয়ে সঙ্গে সঙ্গে নগদ হাতে আসে। দর্শক দেখে, উপভোগ করে, অর্থ আসে হাতে হাতে। গভীর চরিত্রে সঙ্গে সঙ্গে নগদ আসে না হাতে।
এই জায়গা থেকেই আমার উপলব্ধি, উৎপল দত্তের বোধহয় বন্ধু ছিল না কোনও। যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেবলই ওঁর গুণগ্রাহী। বন্ধু নন। প্রকৃত বন্ধু তিনিই যিনি প্রশংসা করবেন অকুণ্ঠ, আবার সমালোচনাও করবেন কোনও ভয় না করে। খ্যাতনামীদের চারপাশে তো সে রকম লোক খুব একটা থাকে না। চারপাশে স্তাবকরাই ঘুরে বেড়ায়। তাই কী করলে আরও একটু ভাল হত— এই পরামর্শ দেয় না তারা। প্রকৃত বন্ধু পেল, তাঁদের সমালোচনা, সঠিক পরামর্শ পেলে তিনি আরও অনেক দূর যেতে পারতেন।
যেমন, ওঁর নাটক ‘স্তালিন ১৯৩৪’। আমার দেখা উৎপল দত্তের সেরা কাজ। এই একটি কাজ ছাড়া ওঁর আর কোনও কাজ ভাল লাগেনি। রুপোলি পর্দায় ওঁর অভিনীত ছবি দেখিনি। তাই বলতে পারব না। তার মানে কি তিনি ভাল অভিনেতা নন? খুব সূক্ষ্ম মাপের অভিনেতা তিনি। কিন্তু ওই যে, নিজেকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারেননি।
আজ তাঁর জন্মদিন, হয়তো এত কঠিন কথা আজ না বললেও চলত। আসলে, উৎপল দত্তের মতো প্রতিভাবান শিল্পীর থেকে আমরা আরও অনেক কিছু আশা করি। আরও উৎকৃষ্ট কিছু, যা আমাদের, বাংলা তথা দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে। কখনও তার অভাব ঘটলে তখন অভিমান হয় বৈকি। সেই অভিমান থেকেই বেরিয়ে আসে কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা। যেমন আজ ওঁকে নিয়ে বলতে বসে জানিয়েছি। এই ভাবনা, এই মত-- সবটাই একান্ত আমার। ওঁকে অশ্রদ্ধা করব বলে বক্তব্য রাখিনি। আবার এও জানি, যাঁকে নিয়ে এত কথা তিনি এ সবের ঊর্ধ্বে। তাঁর লেখা, তাঁর অভিনয়, তাঁর নাটক, তাঁর পরিচালনা-- সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ এক সত্তা। এই সত্তা কিন্তু কোনও দিন প্রচার চাননি। তাই আমার নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠী যখন তাঁকে সম্মাননা জানাতে চেয়েছিল, তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যাননি। অনেক অনুরোধ, উপরোধের পর তাঁকে আমরা সম্মান জানাতে পেরেছিলাম। তাঁর প্রতি এটাই ছিল আমার আসল শ্রদ্ধা।