প্রয়াত মনোজ মিত্র স্মরণে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
আমি ওঁর ছেলের মতো। মনোজ মিত্র আমার ‘স্যর’। এই ছিল আমাদের সম্পর্ক। অনেক স্মৃতি ওঁকে নিয়ে। সব থেকে বড় কথা আমার জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় যে নাটকটি তাঁরই রচনা, ‘দেবী সর্পমস্তা’। এটা মিনার্ভা রেপোর্টারির প্রযোজনা ছিল। পরিচালক হিসাবে আমার এই নাটকটি আজ পর্যন্ত সর্বাধিক জনপ্রিয়। বলতে পারেন, আমার দুই নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ এবং ‘দেবী সর্পমস্তা’ আমার দুই সফল নাটক।
তার ফলে আমার নিজস্ব নাট্যজীবনে মনোজবাবুর ছায়া আজীবন থেকে যাবে। আমাকে স্যর অসম্ভব স্নেহ করতেন। একদম নিজের ছেলের মতো। মনে পড়ছে, উনি তখন নাট্য অ্যাকাডেমির সম্পাদক, আমি সদস্য। সেই সময় এক একজনের নামে স্মারক বক্তৃতা হত। সে দিন শম্ভু মিত্রের স্মারক বক্তৃতা ছিল। আমার উপরে বলার দায়িত্ব। স্যর নিজে বললেন, “দেবেশের দিন আমি থাকব।” নির্বিরোধী, মেধাবী, জ্ঞানী এবং গুণী একজন মানুষ। একই ভাবে অত্যন্ত রসিক। আমরা দু'জনেই ছিলাম বাংলাদেশের। খুলনা জেলার সাতক্ষীরার লোক। এই জায়গা থেকে দেখা হলেই আমরা ঠাট্টা করতাম, “আমরা দেশওয়ালি ভাই।”
আমার সঙ্গে যখন ওঁর আলাপ তত দিনে ওঁর ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে। স্যর খুব মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন। কিন্তু চিকিৎসকের নির্দেশে সে সবে দাঁড়ি পড়েছে। মিষ্টি খাওয়া নিয়ে কথা উঠলে স্যর তাই দুঃখ করতেন, “বুঝলে, আমার মিষ্টি খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
স্যরের অনেক স্মৃতি আজ ভিড় করছে। যেমন, ওঁর লেখা ‘দেবী সর্পমস্তা’র শেষ অংশ একটু পাল্টেছিলাম। মনোজবাবু মহড়ার সময় দেখতে এসেছিলেন। বিরতির সময় যখন আলো জ্বালাচ্ছি তখন ডেকে বললেন, “এত গুলো গান দিয়েছ? এতগুলো গান?” ইতস্তত করছিলাম। স্যর কিন্তু উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ভালই লাগছে।” শেষে আমরা রেখেছিলাম, ‘এত দুঃখ, এত কান্না, এ মানুষ দেখবে না। আমরা চলো নতুন করে নাটকটা শুরু করি।’ সেটা শুনে স্যর বললেন, “এই যে তুমি শেষে বললে ‘চলবে না’, এটা রেখো না। মনে হচ্ছে যেন বলছ, আমারই লেখা নাটক চলবে না।” আমি মেনে নিয়ে শেষটা আবার বদলে দিলাম। তার পর জিজ্ঞেস করলাম, শো-এর দিন আসছেন তো? মনোজবাবু বললেন, “হ্যাঁ, চেষ্টা করব।”
শো-এর দিন সকালে জানালেন, তিনি আসতে পারবেন না। প্রায় মাসখানেক পর তিনি দেখতে এলেন। আমরা তো নাটকের কিছুই বদলাইনি। ভাবছি, বিষয়টি কি স্যরের মনে আছে? শো-এর একদম শেষে আমার কান মুলে দিয়ে বলেছিলেন, “না না, তুই যা করেছিলি ঠিকই করেছিলি। আমি তখন বুঝতে ভুল করেছি।”