লোককথা, নারীবাদ, কুসংস্কার, অলৌকিক শক্তি... এই সব কিছুর মিশেলে তৈরি হয়েছে ‘বুলবুল’। আর ছবির চালচিত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বাংলার জমিদারবাড়ির অন্ধকার অন্দরমহল। এ ছবি ঠিক অস্থিসর্বস্ব ভূতের নয়, বরং সমাজের মননে রয়ে যাওয়া ভূতকেই ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। কিন্তু সেই ভূতের নাগাল পাওয়া কি অতই সহজ?
গল্পের শুরু বুলবুলের বিয়ে দিয়ে। বছর ছয়েকের মেয়ের বিয়ে হয় তার থেকে প্রায় তিন-চার গুণ বেশি বয়সের জমিদারের সঙ্গে। কিন্তু পানপাতার আড়াল থেকে সে যত বার চোখ মেলে দেখেছে, চোখে পড়েছে নীতবর সত্য। সে জমিদারের ছোট ভাই, বুলবুলের চেয়ে একটু বড়। জমিদারবাড়ির বউ ছোট্ট বুলবুল ভয় পায় অত বড় বাড়ির অন্ধকারে। সখ্য গড়ে ওঠে ছোট দেওরের সঙ্গে। সে-ই তখন তার খেলার সাথী, গল্প করার সঙ্গী। পাশাপাশি বড় হয় দু’জনে, সম্পর্কও মজবুত হয়। কিন্তু স্বামীর ঘরও যে করতে হবে মুখ বুজে। ছোট দেওরের বিলেতে পড়তে যাওয়ার কথায় তার মন ভেঙে যায়। অন্য দিকে রয়েছে স্বামীর আর এক যমজ ভাই মহেন্দ্র, যে কি না মানসিক বিকারগ্রস্ত। সে-ও ছাড়ে না বুলবুলের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।
লোককথা ও ঔপনিবেশিক বাংলাকে নির্ভর করে নারীবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন পরিচালক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হিসেবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এক চরিত্র বেছে নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠার ভিত দুর্বল করে দিয়েছেন খানিক। অন্য দিকে একাধিক বিষয় দেখাতে গিয়ে গল্পের জাল বুনতেও ব্যর্থ। মাঝেমাঝেই ঘটনা পরম্পরায় ছেদ পড়ে। একাধিক পুরনো ছবি থেকে পরিচালক যে রেফারেন্স নিয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রত্যেক দৃশ্যে। কিন্তু সেই দৃশ্যের সমষ্টি একটি ছবি হয়ে উঠতে পারেনি, রেফারেন্স হিসেবেই গ্রথিত রয়েছে ছবির মাঝে-মাঝে। ‘চারুলতা’, ‘তিন কন্যা’ ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘চোখের বালি’, ছবির একাধিক দৃশ্য হুবহু উপস্থিত এ ছবিতে। এমনকি উপমা হিসেবে বিনোদিনী ও মহেন্দ্র নামও দেওয়া হয়েছে ছবির দুই চরিত্রকে।
বুলবুল
(ওয়েব মুভি)
পরিচালনা: অন্বিতা দত্ত
অভিনয়: রাহুল, তৃপ্তি, পাওলি, পরমব্রত
৫.৫/১০
তবে উনবিংশ শতকের বঙ্গভূমিকে বেশ ভালই ধরা হয়েছে লেন্সে। সেখানে যেমন আছে অলস দুপুরের গল্পগাছা, তেমনই আছে লুকিয়ে রাখা কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য। এক একটা উপলব্ধি, অনুভূতিও পরিচালক ধরেছেন সুন্দর। ছোট দেওরের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আকুল বুলবুলকে প্রেমবঞ্চিত বিনোদিনীর পিছু ডাক, বছর ছয়েকের কনেকে গাছ থেকে নামিয়ে কোলে করে ছাদনাতলায় নিয়ে যাওয়া, গয়নার জৌলুসহীন বৈধব্যে রুপোর পানের বাটা আগলে রাখা... ক্ষয়ে যাওয়া জমিদারির গায়ে ফুটে থাকা রত্নের মতো এমনও মুহূর্ত আছে ছবি জুড়ে। ক্রিমসন রেড টোন ও আলোআঁধারিও এক অদ্ভুত মায়াজাল বিস্তার করেছে।
আর আছে ছোটবেলায় বড়দের মুখে শোনা ডাইনির গল্পের মায়াজাল। সন্ধের পরে এলোচুলে যে গাছে বসে পা দোলায়, সে-ও আছে সমাজের পুরুষতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত হানার জন্য। বাস্তবের মাটিতে রূপকথার জাল বিছিয়ে দর্শককে ভালই ধরে রেখেছিলেন পরিচালক। কিন্তু শেষে গাছে গাছে দৌড়ে বেড়ানো অলৌকিক শক্তির আশ্রয় না নিলেই পারতেন। আর যে সময়কাল ধরা হয়েছে, সেখানে অর্ধনগ্ন জমিদার-গিন্নির ঘরে অত কমবয়সি পুরুষ চিকিৎসকেরও কি প্রবেশের অনুমতি ছিল? পরিচারিকা বা বাড়ির অন্য মহিলাদের অনুপস্থিতিতে! তথ্যগত ত্রুটিও ইতিউতি নজরে পড়ে। একাধিক বিষয় নিয়ে জাগলিং করতে গিয়ে পরিচালকের হাতও কেঁপেছে তবে এ ছবির অভিনেতারাই আসল জিয়নকাঠি, যাঁরা শেষপর্যন্ত তাঁদের দিকে ধরে রেখেছেন দর্শককে। মুখ্য চরিত্রে তৃপ্তি দিমরি কখনও নিষ্পাপ, কখনও কলঙ্কিনী, কখনও অভাগী, কখনও শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। শুধুমাত্র তাঁর চোখের মেকআপ ও চাহনিতে তিনি একের পর এক শেডস তৈরি করে গিয়েছেন। আগাগোড়া নজর কেড়েছেন পাওলি দামও। তাঁর ওঠা, বসা, চালচলনে সেই অলস সময় ধরা পড়েছে। পরমব্রতও তাঁর চরিত্রে যথাযথ। বরং সুযোগ থাকলেও স্পটলাইট কাড়তে পারেননি রাহুল বসু এবং অবিনাশ তিওয়ারি। আর একটা বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। সেটা হল দুই বয়সের বুলবুলের চরিত্রে যাঁরা দু’জন অভিনয় করেছেন, তাঁদের চেহারার সাদৃশ্য। তার জন্য বাহবা প্রাপ্য কাস্টিং ডিরেক্টরের।
আরও পড়ুন: ‘স্বজনপোষণকে আমরাই আদর করে বয়ে বেড়াচ্ছি’, টুইটে বলিউডকে দুষলেন সুস্মিতা সেন
সযত্নলালিত নয়, বরং পতিত ভূমিই শরতে ভরে ওঠে কাশফুলে। যেন শুভশক্তির সূচনার দ্যোতক! ছবির শেষে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির আঙিনায় ফুটে থাকা কাশফুল যেন সেই আভাসই দিয়ে যায়। অশুভকে হারিয়ে শুভশক্তির জয়। তার দিকে চেয়েই তো বসে আছে আজকের পৃথিবী।