অঙ্কুশ হাজরা। — ফাইল চিত্র
টলিউডে বাণিজ্যিক ছবির হারানো দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন অঙ্কুশ। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি এগিয়ে চলায় বিশ্বাসী। মুক্তি পাচ্ছে অঙ্কুশ হাজরা প্রযোজিত ও অভিনীত প্রথম ছবি ‘মির্জ়া’। প্রযোজনা, স্টারডম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে অকপট অভিনেতা। সম্প্রতি বাইপাস সংলগ্ন এক রেস্তরাঁয় পড়ন্ত বিকেলে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডা দিলেন তিনি।
প্রশ্ন: প্রযোজক হিসেবে অবশেষে প্রথম ছবি মুক্তি পেতে চলেছে। মনের মধ্যে কী চলছে?
অঙ্কুশ: অদ্ভুত লাগছে। আনন্দের পরিবর্তে অনেক স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় করছে। কারণ আমি কিন্তু অন্য অভিনেতাদের মতো প্রযোজনায় আসিনি। ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ তারকা ছবির প্রযোজনার ক্ষেত্রে, হয় বাইরে থেকে বিনিয়োগকারী নিয়ে আসেন বা মুনাফা ভাগ করে নিতে চান। নিজের টাকা দিয়ে ‘মির্জ়া’ তৈরির ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু সেটাই করতে হয়েছে। তাই কী প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত বুঝতে পারছি না।
প্রশ্ন: ছবির ঘোষণার পর প্রযোজক পরিবর্তনের পাশাপাশি লাগাতার ছবি নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। আপনি সমাজমাধ্যমে তার উত্তরও দিয়েছেন। মনের মধ্যে জেদ বজায় রাখা কতটা কঠিন ছিল?
অঙ্কুশ: কথা দিয়েছি মানে কথা রাখব। এমন একটা ছবি তৈরি করতে চেয়েছি, যেটা দেখে সকলে যেন তাকিয়ে থাকে। তাই টেনশন খুব একটা ছিল না। মাঝে বেশ কয়েকটা ছবি করলাম। দেখলাম ফ্লপ করল। মানুষ বলছিলেন অঙ্কুশ হারিয়ে যাচ্ছে। তখন নিজেই ভেবে দেখলাম কী ভুল করছি। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম যে ‘মির্জ়া’ই তৈরি করব।
'মির্জা' ছবিতে অঙ্কুশের লুক। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন: এই ছবিটা কি আপনার কেরিয়ারের সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ?
অঙ্কুশ: বিশ্বাস করুন, সব দিক থেকে! ছবিটা কী ভাবে তৈরি করেছি, সেটা নিয়েই একটা আলাদা ছবি তৈরি হতে পারে। যাঁরা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রত্যেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ফিক্সড ডিপোজ়িট ভাঙিয়ে টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। মালাইচাকি ঘুরে যাওয়া, সিস্ট অপারেশন— পর পর আমার চোট। এত কিছু পেরিয়েও যে ছবিটা করতে পেরেছি, তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
প্রশ্ন: যাঁরা মুখ ফিরিয়েছিলেন, এখন তাঁদের কিছু বলতে চান?
অঙ্কুশ: তাঁদের দেখে মায়া হয়। কিন্তু কোনও রাগ নেই। পাঁচ-ছয় কোটি টাকার একটা ছবি। অনেকে ভাবতেই পারেন তারকাদের কাছে এটা কোনও চিন্তার বিষয়ই নয়। কিন্তু আমার কাছে এই টাকাটা অনেক এবং সেটা আমাকে জোগাড় করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু এই সফরে অনেকেই তো আপনার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
অঙ্কুশ: অবশ্যই। সবার নাম নিয়ে শেষ করতে পারব না। শ্রীকান্তদা (প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা) শুটিংয়ের প্রথম দিনেই সেটে এসেছিলেন। রানেদা (প্রযোজক নিসপাল সিংহ রানে) ছবিটার পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন। দেব নিয়মিত ফোনে পরামর্শ দিয়েছে। জিৎদা আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: এখন তো বক্স অফিসে পারিবারিক ছবির ফর্মুলা সফল। সেখানে আবার বাণিজ্যিক মশালা ছবি ফিরিয়ে আনার মধ্যে তো ঝুঁকি রয়েই যায়।
অঙ্কুশ: আমি বিশ্বাস করি সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। এক সময়ে ‘অটোগ্রাফ’ ছবিটাকেও মুক্তির পরে সবাই ‘ঝুঁকি’ বলেছিল। এখন আবার দর্শক ‘কেজিএফ’ বা ‘পুষ্পা’র মতো ছবি চাইছেন। সব কিছুই ফিরে ফিরে আসে।
প্রশ্ন: এখন তো বলা হয় দেশ জুড়ে ‘স্টারডম’-এর সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। টলিউডে সেটা বজায় রাখা কি এখন কঠিন?
অঙ্কুশ: খুব কঠিন। কনটেন্ট ভাল হলে সেই ছবি কোনও তারকার ছবিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। তাই স্টারডম প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে মাচায় যখন যাই, তখন এক জন নায়ককে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা, তা এখনও অনুভব করি। মাঝে অনেকেই একাধিক তারকা নিয়ে বাংলা ছবির কথা বলছিলেন। কিন্তু সেটা কোনও সমাধান নয়। কারণ এই রকম কোনও ছবির ট্রেলার যদি খারাপ হয়, তা হলে দর্শক আর ছবি দেখতে হলেই যাবেন না। তারকার উপর ভরসা থেকে কিছু মানুষ ছবি দেখবেন। কিন্তু তা দিয়ে ছবির টাকা ফেরানো যাবে না।
প্রশ্ন: অভিনেতাদের কি হতাশা গ্রাস করে?
অঙ্কুশ: অবশ্যই। আমাদের বিচার করা হয়। আমাদের নিয়ে আলোচনা এবং লেখা হয়। সঙ্গে রয়েছে ট্রোলিং! মাঝেমাঝে মনে হয়, যাঁরা বলছেন, আমি তো তাঁদের কোনও ক্ষতি করিনি। কিন্তু সকলের দরজায় তো কড়া নেড়ে সেটা বলতে পারব না। তাই এখন অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি।
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন ‘মির্জ়া’ যাতে ভাল ভাবে মুক্তি পায়, তার জন্য নাকি আপনি বহু প্রযোজককে তাঁদের ছবি এই সময়ে না আনতে অনুরোধ করেছেন..
অঙ্কুশ: না। বাংলায় এটা অন্যায় আবদার। বাংলায় এখন ছবি মুক্তি পেলে বক্স অফিসে কী হচ্ছে, সেটা আমরা সবাই জানি। সবাই দুর্গাপুজো, বড়দিন বা সরস্বতী পুজোর মতো একটা ভাল সময়ে তাঁদের ছবিটা রিলিজ় করতে চান। সেখানে আমি যদি আমার জন্য কাউকে তাঁর ছবি পিছিয়ে দিতে বলি, তা হলে তাঁকে আবার তাঁর ছবি মুক্তির জন্য একটা অন্য সময়ও আমাকে বেছে দিতে হবে। অনুরোধের পাশাপাশি এই কর্তব্যটাও তখন আমার উপর বর্তাত।
প্রশ্ন: মাঝে ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকমও গুঞ্জন ছড়িয়েছিল যে হাতে কাজ নেই বলে, আপনি নাকি প্রযোজকদের ছবির স্যাটেলাইট স্বত্ব বিক্রিতে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলতেন...
অঙ্কুশ: (থামিয়ে দিয়ে) প্রথমত, আমার হাতে কাজ নেই, ঈশ্বরের আশীর্বাদে এখনও কেরিয়ারে এ রকম সময় আসেনি। খারাপ ছবি করেছি। কিন্তু কাজ নেই, এটা হয়নি। স্যাটেলাইট পাইয়ে দেব, কোনও দিন বলিনি। কারণ ওটা আমার দেখার জিনিস নয়। এটুকু হয়তো বলেছি যে আমার ছবির স্যাটেলাইট স্বত্ব যেন নষ্ট না হয়। কারণ নতুন অনেক প্রযোজকই চটজলদি টাকার লোভে স্যাটেলাইট বিক্রি করেন। আমার মতে, একটা ছবিকে আগে প্রেক্ষাগৃহে ধরে রাখা উচিত। প্রি-সেল করলেও অন্তত যেন জলের দরে না দিয়ে দেন, সেটাই বলেছি।
প্রশ্ন: ওয়েব সিরিজ়, সিনেমার পাশাপাশি ছোট পর্দা— কাজ করে চলেছেন। মাঝে কি আপনার একটু গাইডেন্সের অভাব ছিল?
অঙ্কুশ: মিস্ গাইডেড হইনি। আমি শিশু নই। হয়তো ইএমআই-এর কথা চিন্তা করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টেবিলে আলোচনার সময় সব সিনেমাকেই মনে হয়, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ বা ‘শোলে’! বাস্তবে সেটা হয় না। অনেক প্রযোজকের মিথ্যা আশায় ভরসা করে সেই ছবিগুলোকে হ্যাঁ বলেছিলাম। বড় ছবি বলে ১১ দিনে শুটিং শেষ। ছবির প্রচার হয়নি। তার পর ওটিটিতে রিলিজ়। যদি কোনও ভুল পদক্ষেপ নিয়ে থাকি, সেটা আমার দোষ।
প্রশ্ন: ‘মির্জ়া’র সিক্যুয়েল নিয়ে কোনও ভাবনা?
অঙ্কুশ: এই ছবি থেকে যদি আমি আমার বিনিয়োগ করা টাকাটুকুও যদি ফেরত পাই, তা হলেও আমি ‘মির্জ়া’র তিন গুণ বেশি বাজেটে সিক্যুয়েল তৈরি করব। আর যদি ছবি লাভের মুখ দেখে, তা হলে দক্ষিণী ছবির মতো করেই সিক্যুয়েলের পরিকল্পনার ইচ্ছে রয়েছে।
প্রশ্ন: ঐন্দ্রিলাকে বিয়ের প্রসঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে একই উত্তর দিচ্ছেন। এ বার নতুন কিছু শুনতে চাই।
অঙ্কুশ: (হেসে) বিয়ে করব। আমি চাই জীবনের এই সময়টা ঐন্দ্রিলা আরও একটু উপভোগ করুক। সিরিয়ালে অভিনয় করেছে। কিন্তু ওর স্বপ্ন ছিল, বড় পর্দায় নায়িকা হবে। সেটা সবে শুরু হয়েছে। তাই এখনই ওকে সংসারের দায়িত্ব দিতে চাই না। আর ঐন্দ্রিলা কিন্তু সারা ক্ষণ কাজের পিছনে দৌড়য় না। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে ও অবগত। তাই জানি এখন বিয়ে করলেই ও কেরিয়ারের তুলনায় সংসার নিয়ে মাথা ঘামাবে।
প্রশ্ন: তারকাদের জীবন নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। না-চাইলেও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা। যেমন কাঞ্চন-শ্রীময়ীর বিয়ে। এটা কি উচিত?
অঙ্কুশ: আমার মতে এই পেশায় আমরা উচিত বা অনুচিত— সবটাই জেনেবুঝেই এসেছি। তারকারা তো পণ্যের মতো। তাই এই কৌতূহল মেনে নিতেই হবে। এই ভাবেই গ্ল্যামার দুনিয়া চলে। তাই কেউ যদি বলেন যে তাঁর এই কৌতূহল পছন্দ নয়, তা হলে মিথ্যা বলছেন। কারণ প্রত্যেকেই প্রচার পছন্দ করেন।
প্রশ্ন: আপনাদের বিয়েতে সাংবাদিকেরা আমন্ত্রিত থাকবেন তো?
অঙ্কুশ: (হেসে) সবাইকে আমন্ত্রণ জানাব। যদি দেখি বিয়ের খরচের বাজেট বাড়ছে, তা হলে আরও এক বছর বিয়ে পিছিয়ে দেব। কিন্তু অতিথি তালিকা থেকে কেউ বাদ না পড়বেন না, কথা দিচ্ছি।