কালচে লাল রঙের গুড় বাতাসা, চড়াম চড়াম ঢাক এবং আবহাওয়া দফতরের তাপপ্রবাহের সতর্কতার আবহে ভোটের ডিউটির খবর এল। ২৬১, কেতুগ্রাম। খবরের শিরোনামে প্রায়শই উঠে আসা এই বিধানসভা কেন্দ্রে ডিউটি পড়েছে শুনে সাবধানবাণী শুরু হল আত্মীয়-পরিজনেদের। দুর্বল মনটাকে ভরসা জোগাচ্ছিলাম কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির কথা ভেবে। গত তিন দফার অভিজ্ঞতায় কঠোরতর নির্বাচন কমিশন বনাম ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার শক্ত চোয়াল— এই দুইয়ের মাঝে উলুখাগড়া রেফারি হিসাবে নির্দিষ্ট দিনে তেতেপুড়ে হাজির হলাম কাটোয়া ডিসিআরসিতে।
কর্তব্যপরায়ণ তৃতীয় পোলিং আধিকারিক আগেভাগে তত্ত্বতালাশ করে কাজটা অনেক সহজ করে রেখেছিলেন। কিন্তু বাধা পড়ল ‘অফলাইন ওয়েব কাস্টিং ট্যাগিং’ করতে গিয়ে। চাঁদি ফাটা রোদ্দুরে হন্যে হয়ে ঘুরে অবশেষে জানালায় দড়ি দিয়ে বাঁধা এয়ার কন্ডিশন ও নতুন পর্দা লাগানো একটি অস্থায়ী ঘর দেখে কোনও এক উচ্চ আধিকারিকের অফিস ভেবে ঢুকে পরলাম। সিনেমার চেনা ভিলেন ড্যানির মতো দেখতে এক জন মন দিয়ে ট্যাব ঘাঁটছিলেন। ‘ওয়েবক্যাম ট্যাগিং’— এর সমস্যার কথা বলতেই দোভাষীর কাছ থেকে বিষয়টি বুঝে নিলেন তিনি। রিটার্নিং অফিসারকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও নির্দেশ দিলেন। দোভাষীটি চটপট বাইরে এসে আমাকে বললেন- “আপনি মশাই একেবারে ভিন রাজ্য থেকে আসা আইএএস অফিসার তথা পর্যবেক্ষকের কাছে চলে এলেন?” পরে কেতুগ্রামের বিডিও-র ফোন নাম্বার দিয়ে দায় সারলেন তিনি। আমি ওনাকে ফোন করে সম্যসার কথা বলে ভয়েস কল রেকর্ড করে নিলাম। এবং একটি এসএমএস করে দিয়ে ওয়েব ক্যাম ছাড়াই বুথে পৌঁছনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের বুথের জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ থাকায় কাটোয়া থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের সীমান্তে কবি জ্ঞানদাসের জন্মভিটে কান্দরা গ্রামে পৌঁছনো সহজ হল। বেশ কয়েকটি ভুল বুথ ঘুরে গ্রামের শেষে মাঠের প্রান্তে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উষ্ণ অভ্যর্থনায় প্রবেশ করলাম ‘গণতন্ত্রের গর্ভগৃহে( একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র)’।
ভোট পুজার উপাচারে মনোনিবেশ করতেই কয়েকজন যুবকের আশ্বাস বাণী, “এখানে কোনও বিরোধী এজেন্ট নেই। আপনাদের কোনও ভয় নাই। শুধু উপযাচক হয়ে কিছু বলবেন না। এখানে ভোট শান্তিপূর্ণই হয়।’’ বিনা খরচে খাওয়ানোর আশ্বাস দিয়ে জানালেন এটা তাঁদের কর্তব্য। ভোট দেওয়ার কামরাটিকেও একেবারে রাস্তার ধারে দরজার সামনে কোথায় রাখা হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে গেলেন তাঁরা। বুঝতে বাকি রইলনা, ভোটের আগের দিনের ভূতের নাচ কী। তবুও রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঘরের অন্য নির্জন প্রান্তে ব্যালট ইউনিট বসিয়ে গোপনীয়তা সুরক্ষিত করলাম। রাতের খাওয়ার পরে সেক্টর অফিসের আধিকারিক দুটি ছবিবিহীন পরিচয়পত্র দিয়ে গেলেন। কোনও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর রাঁধুনির দেখা অবশ্য মিলল না।
একে তো বিরোধী এজেন্টশূন্য ভোট, তায় কেতুগ্রাম— ভাবলাম কেন্দ্রীয় বাহিনীর কমান্ডারের সঙ্গে ছোট্ট বৈঠক সেরে নেওয়া উচিত। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা শুক্লাবাবু দৃঢ় ভাবে জানালেন, ভোট ভোটের মতো হবে। আশ্বস্ত করে বললেন “আপ সভিকো সিকিউরিটি দেনা পুরা মেরে জিম্মেদারি।” এ কে ৪৭-এর ম্যাগাজিন খুলে দেখিয়ে বললেন “পুরা ভরা হুয়া হ্যায়।’’ বীর জওয়ানের ভরসায় চালু করলাম ভোট।
মাছি গলারও সুযোগবিহীন বুথে অসন্তুষ্ট একাকী এজেন্টের তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। দুপুর ২টো বেজে গেলেও মনের মতো ভোট হচ্ছে না দেখে রাতে দেওয়া খাবারের প্রতিশ্রুতিও ভুলে মেরে দিলেন তিনি। শেষে দূর হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে উপোস কাটালাম। ততক্ষণে কর্তব্যপরায়ণ জওয়ানের হাতে দ্বিতীয় বার ভোট দিতে এসে ধরা পড়ে কান ধরে ওঠবোস করছেন এক যুবক। একটু ছাড় মিলতেই বোল্টকে হার মানানো গতিতে পালাতেন তিনি। হাসতে হাসতেই শেষ হল ভোট।
৬.২৫ মিনিটের মধ্যেই রওনা দিলাম ডিসিআরসিতে। গাড়ি ছোট হওয়ায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে গন্তব্যে পৌঁছলাম। দেখি আমরাই প্রথম। ওদের বিস্ময়মাখা প্রশ্ন— “অত দূর থেকে এত তাড়াতাড়ি? সব ঠিকঠাক আছে তো?” আমরা হাসলাম। সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আমাদের নির্ভুল কাজের প্রশংসা করে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দিলেন। বাড়ি ফেরার পথে এক সহকর্মী বললেন, ‘‘ভোট-জীবনে এই প্রথম এত তাড়াতাড়ি ফিরছি।”
(লেখক বিটরা এলাকার শাহাজাদপুরের বাসিন্দা)