বিষ্ণুপুর হাসপাতালে প্রহৃত মহিলারা।—নিজস্ব চিত্র
ভোটের আগে তাদের উপদ্রব ছিল। বাছাই করা বিরোধী ভোটারদের বাড়িতে গিয়ে তারা শাসানি দিয়েছিল, ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই। কোথাও বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ ভোটকর্মীদের মারধরও করেছে তারা। সোমবার, ভোটের দিনও তাদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়েছে। ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও শাসকদলের ‘ভূত’ দেখছে বাঁকুড়া।
মঙ্গলবার সকালে যেমন দেখল জয়পুর থানার হরিণাশুলি গ্রাম। এখানকার কয়েক ঘর সিপিএম সমর্থক পরিবারের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। পুরুষেরা কোনও মতে পালিয়ে গেলেও হামলাকারীদের হাতে মার খেলেন চার মহিলা। তাঁদের বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রত্যেকের মাথায়, হাতে চোট রয়েছে। প্রহৃত রহিলা বিবি, ডালিয়া বিবি, রাইসনা বিবি, সাদেকা বিবিরা বলেন, ‘‘এ দিন জনা সাতেক লোক মোটরবাইকে চেপে এসে বাড়ির পুরুষদের খোঁজ করে। তাদের না পেয়ে চেঁচিয়ে বলে ‘আমাদের না জানিয়ে কেন ভোট দিতে গিয়েছিলি।’ এর পরেই ‘ভোট দেওয়া বের করছি’ বলে লাঠি-রড দিয়ে আমাদের পেটায়।’’ ওই মহিলারাই জানালেন, তাঁরা সিপিএমের সমর্থক হওয়ায় ভোটের দিন কয়েক আগে থেকেই তৃণমূলের লোকজন তাঁদের ভোট দিতে যেতে মানা করে হুমকি দিচ্ছিল।
এই এলাকাটি কোতুলপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। সেখানকার জোট প্রার্থী, কংগ্রেসের অক্ষয় সাঁতরার নির্বাচনী এজেন্ট তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তাপস চক্রবর্তী জানান, আহত এক মহিলার এক স্বামী আবু কাশেম মণ্ডল জয়পুর থানায় লাল মহম্মদ ভুঁইয়া-সহ ৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের গুন্ডাদের নির্দেশ না মানার জন্যই এই ঘটনা ঘটেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকাতেই ওরা জোটের কর্মী-সমর্থকদের উপরে হামলা চালাচ্ছে। ভোটের পরে কোতুলপুরের সর্ষেদিঘি গ্রামে শেখ বাবুরামের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমুলের দুষ্কৃতীরা। শিরোমণিপুর গ্রামে আমাদের এক সমর্থকের কষাইখানাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে ঘটনার কথা ফোনে জানানো হয়েছে।’’
হরিণাশুলির ঘটনার কথা অস্বীকার করে তৃণমূলের জয়পুর ব্লক কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবিয়াল মিদ্যার দাবি, সিপিএম সাজানো নাটক করে তৃণমূলের কর্মীদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তেমন কিছুই সেখানে হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, মারধরের একটি অভিযোগ কাছে এসেছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুধু জয়পুরই নয়, সিপিএমের কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন পাত্রসায়র থানার জামকুড়ি অঞ্চলেও। সেখানে ভোটগ্রহণের পরে সিপিএমের দুই পোলিং এজেন্টের বাড়িতে চড়াও হয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় এলাকায় ফের উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
ভোটের আগের দিন, রবিবার সকালে পাত্রসায়র থানারই নুতনবাজার এলাকায় সিপিএমের পাত্রসায়র লোকাল কমিটির সদস্য সাধন বাগদিকে রাস্তায় আটকে মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় সোনামুখী কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী দীপালি সাহার নির্বাচনী এজেন্ট সুব্রত ওরফে গোপে দত্ত-সহ ১৮ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সোমবার ভোট শেষ হওয়ার পরে রাতে জামকুড়ি অঞ্চলের নান্দুড় গ্রামে হিরণ্ময় দে এবং বরুজপোঁতা গ্রামে শেখ মোয়াজ্জেমের বাড়িতে তৃণমূলের লোকেরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ। সেই সময় হিরণ্ময় বাড়িতে থাকলেও মোয়াজ্জেম ছিলেন না। এই অঞ্চলটি ইন্দাস বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
সিপিএমের পাত্রসায়র জোনাল কমিটির আহ্বায়ক লালমোহন গোস্বামীর অভিযোগ, “নান্দুড় ও বরুজপোঁতা প্রাথমিক স্কুলের বুথে ইন্দাস কেন্দ্রে আমাদের দলের প্রার্থী দিলীপ মালিকের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন হিরন্ময় দে ও মোয়াজ্জেম। ভোটের আগে থেকেই তৃণমূলের লোকেরা ওঁদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ওঁদের বাড়িতে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হামলা করে। বাড়ি ভাঙচুরের পাশপাশি লাঠি, রড দিয়ে হিরণ্ময়কে বেধড়ক মেরেছে ওরা। মোয়াজ্জেমের বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তবে মোয়াজ্জেম দ্রুত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেয়েছেন। ’’এর পর তৃণমূলের লোকেরা বাঁকিশোল গ্রামেও এক সিপিএম সমর্থকের দোকানে ভাঙচুর চালিয়েছে বলে তাঁর দাবি। তিনি জানান, গ্রামের মানুষই হিরণ্ময়কে উদ্ধার করে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হচ্ছে।
অভিযোগ মানতে চাননি ইন্দাসের তৃণমূল প্রার্থী গুরুপদ মেটে। তিনি বলেন, “এমন কিছু হয়েছে বলে শুনিনি।’’ তবে হিরণ্ময়কে মারধরের ঘটনা যে ঘটেছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূল নেতা প্রভাত ওরফে বুলে মুখোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “সোমবার রাতে নান্দুড় গ্রামের বাউরিপাড়ায় একটি মহিলাঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে মার খেয়েছেন হিরণ্ময়। ওই পাড়ার বাসিন্দারাই তাঁকে মেরেছে। বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ঠিক নয়। বরুজপোঁতা গ্রামে মোয়াজ্জেমের বাড়িতে হামলার অভিযোগ মিথ্যা।’’ আর বাঁকিশোল গ্রামে রাস্তা দখল করে সিপিএমের এক সমর্থক গায়ের জোরে মুরগির দোকান করেছিলেন। এলাকার মানুষই সেই দোকান ভেঙে দিয়েছেন বলে শুনেছি। কোন ঘটনার সঙ্গেই আমাদের দলের কেউ জড়িত নয়”। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, সোমবার রাতে মৌখিক অভিযোগ পাওয়া মাত্র ওই গ্রামে পুলিশ গিয়েছিল। বাড়ি ভাঙচুর বা মারধরের লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।