ঘাড় মটকাল কারা, বিচারের অঙ্ক কষছে যাদবপুর

মোবাইলে নতুন একটা কলার টিউন লেগেছে শুধু। ‘সূর্যোদয়ের নতুন আলো, দিন বদলের আশায় রাঙালো…’! বাকি সব একই আছে।তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরও অবতার বদল হয়নি।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩০
Share:

সুজন চক্রবর্তী ও মণীশ গুপ্ত

মোবাইলে নতুন একটা কলার টিউন লেগেছে শুধু। ‘সূর্যোদয়ের নতুন আলো, দিন বদলের আশায় রাঙালো…’! বাকি সব একই আছে।

Advertisement

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরও অবতার বদল হয়নি। রাজনীতিতে পাঁচটা বছর কেটে গেলেও এখনও আগে আইএএস, পরে নেতা! যে ধরনের প্রচারে তাঁর দল গোটা বাংলা ঝালাপালা করে দিচ্ছে, তিনি ঠিক তার মধ্যে নেই। নিজের মতো করে নিজের কথা বলতেই এখনও স্বচ্ছন্দ।

প্রথম জনের ডাক আছে নানা এলাকা থেকে। ফাঁক বার করে নিজের কেন্দ্র থেকে অন্যত্র গিয়ে প্রচার করে আসছেন। তাঁর হয়ে প্রচারেও সভা, মিছিল। দ্বিতীয় জনের যদিও কেন্দ্রের বাইরে যাওয়ার বালাই নেই। অল্প লোকের বৃত্ত নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রচারে তিনি এখনও বেশি অভ্যস্ত।

Advertisement

সুজন চক্রবর্তী ও মণীশ গুপ্ত কেউ প্রচারে ব্যক্তিগত ভাবে কারও বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না। সুজনবাবু শুধু এইটুকু বলবেন, ‘‘যাদবপুরের রূপকার বলে যিনি নিজেকে দাবি করছেন, তাঁর আমলে বিদ্যুতের উৎপাদন কমে গেল। শিল্প নেই বলে বিদ্যুতের চাহিদাও পড়ে গেল। তার পরে কি রূপকার বলা উচিত?’’ মণীশবাবু আরও আগে দাঁড়ি টেনে দেবেন! ‘‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনও দলের অধিকার আছে তাদের পছন্দমতো প্রার্থী দাঁড় করানোর। সব প্রার্থীই সম্মাননীয়।’’

তার মানে ভোটের যাদবপুর এ বার নিস্তরঙ্গ! এবং এখানেই মস্ত ভুল! পরিসংখ্যানই যেখানে এত উত্তেজক, বাস্তবে লড়াই তো সেখানে একেবারে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে! কেমন পরিসংখ্যান? দু’বছর আগের তথ্য বলছে, সে বার যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের সুগত বসুর কাছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ভোটে হেরেছিলেন সিপিএমের সুজনবাবু। কিন্তু যাদবপুর বিধানসভা এলাকায় তাঁর ‘লিড’ ছিল ৩০৯ ভোটে! ওই বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস পেয়েছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার ভোট। এ বার জোটের বাজারে সেই ভোট সিপিএমের সঙ্গে যোগ হলে সুজনবাবু সামান্য এগিয়ে। কিন্তু সামান্যই!

এই সামান্য এগোনোকে আরামদায়ক ব্যবধান করে তোলার জন্য সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক আবার খাটছেন বিস্তর। জেলা সিপিএম যাদবপুর থেকে প্রথমে প্রার্থী করতে চেয়েছিল সূর্যকান্ত মিশ্রকে। কিন্তু সূর্যবাবু
নিজের নারায়ণগড়কেই বেছে
নেওয়ায় জেলা সম্পাদক নেমেছেন যাদবপুরে। রাজ্য সম্পাদককে দল যেখান থেকে প্রার্থী করতে উদ্যোগী হয়, তার মানে অবশ্যই সেটা ভাল আসন— নিজের চার পাশে এ রকম একটা বাতাবরণ নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন সুজনবাবু। পাড়ায়-কলোনিতে, ফ্ল্যাটে-বস্তিতে পা চালাচ্ছেন বিস্তর।

তৃণমূলের ‘বিশ্বাসভঙ্গে’র ইতিহাসই সুজনবাবুর অস্ত্র। ‘‘উন্নয়নের কথা বলে যারা পরিবর্তন চেয়েছিল, তাদের পাঁচ বছরে কী দেখলেন মানুষ? দুর্নীতি আর দুর্নীতি! সারদায় দুর্নীতি, নারদে দুর্নীতি, উড়ালপুলে দুর্নীতি। চাকরি দিতেও দুর্নীতি।’’ বলছেন সিপিএম প্রার্থী। শুধু হা-হুতাশ করে থেমে গেলেই যে চলবে না, মনে করিয়ে দিচ্ছেন সে কথাও। তাঁর কথায়, ‘‘সারদা বা ওই রকম নানা সংস্থায় যে মানুষগুলো সর্বস্বান্ত হল, তাঁদের টাকা ফেরত দিতে হবে না? বিচার পেতে হবে না?’’ সারদা থেকে টেট, প্রতারিতদের জন্য বিচার পেতে তাঁকে একটা ভোট। বস্তি থেকে মধ্যবিত্ত পল্লিতে ঘুরে ঘুরে বুঝিয়ে চলেছেন প্রাক্তন সাংসদ।

পাঁচ বছর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে যাদবপুরে হারিয়ে তারকা হয়ে-ওঠা মণীশবাবু এতে বিচলিত হতে নারাজ। তিনি পাল্টা বলছেন, ‘‘সারদা, নারদা এ সবে এখানে কিছু এসে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। পরিবর্তনের জন্য সে বার ভোট চেয়েছিলাম, যাদবপুরে পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ এটাই দেখছেন।’’ কী রকম পরিবর্তন? মণীশবাবুর যুক্তি, মানুষ জল আর বিদ্যুৎ নিয়ে সব চেয়ে বেশি চিন্তায় ছিলেন। সেই চিন্তা দূর হয়েছে। বস্তিবাসীদের জমির অধিকার যথাসম্ভব দেওয়া হয়েছে। স্কুলে সৌর আলো লাগিয়ে বিদ্যুতের বিল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তা হয়েছে, আলো লেগেছে, সেজে উঠেছে পার্কগুলো।

বিরোধীরা অবশ্য প্রশ্ন তুলছে, রাস্তায় আলো জ্বললেই মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়ে না। পার্ক সাজলেই আইনশৃঙ্খলা ভাল হয়ে যায় না। তা ছ়়াড়া, বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশবাবুর আমলে বিদ্যুতের দাম বাড়ার বিরুদ্ধে পোস্টার আছে এলাকা জু়ড়ে। যা সামাল দিতে মণীশবাবুকে বলতে হচ্ছে, ‘‘বিদ্যুতের দাম সরকার ঠিক করে না। তার জন্য নিয়ন্ত্রক কমিশন আছে। এ বার কিছু কয়লার খনি পাওয়া গিয়েছে। দিল্লির চেয়ে এখনও কলকাতায় বিদ্যুতের দাম কম। কয়লার উৎপাদন বেড়ে গেলে মাসুল আরও কম হবে নিশ্চয়ই।’’

এই আলোচনা আরও চলতেই পারে। মণীশবাবু দাবি করতেই পারেন, নিজের কেন্দ্রে তাঁর কোথাও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভোটটা কি আদৌ রাস্তা-পার্ক-আলো বা বিদ্যুতের উপরে হচ্ছে? নাকি দুর্নীতির নাগপাশ থেকে মু্ক্তি পেতে, গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই হচ্ছে? যে কারণে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট এবং সুজনবাবু সেই জোটের অন্যতম কান্ডারি। জোটের মুখ হিসেবে যিনি পয়লা সারিতে, তিনি মাঠে নামলে ৩০৯-এর ‘লি়ড’ যে আরও এগোবে— এই অঙ্ক কি সাফ নয়?

অঙ্কের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাজনীতি। রবীন্দ্র পল্লির মধ্যে দিয়ে রিকশা চালাতে চালাতে এক প্রৌঢ় যে বলছিলেন, ‘‘ভোটে যে-ই জিতুক, আমাদের রিকশা টেনেই খেতে হবে। ওরা ৩৪ বছর অনেক এলোমেলো করে রেখে গিয়েছিল। আর এরা পাঁচ বছরে ঘাড় মটকাচ্ছে!’’

ঘাড় সোজা রাখার লড়াইটাই ক’বছরে দেখিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সেখানকার এক প্রাক্তনীর জন্য একই লড়াইয়ে পুরনো এক লাল দুর্গের ফের রাঙা হয়ে ওঠা কি এমন অসম্ভব?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement