প্রস্তুতি: ইভিএম মেশিন দেখে নিচ্ছেন কর্মীরা। নির্মাল্য প্রামাণিক
তৃণমূলের এক সময়ের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বনগাঁ মহকুমায় গত লোকসভা ভোটে চারটি বিধানসভা আসনেই পিছিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর। এ বার বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা এবং বাগদা কেন্দ্রে প্রার্থী বদল করেছে তৃণমূল। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস এবং গাইঘাটার বিদায়ী বিধায়ক পুলিনবিহারী রায়কে দল এ বার প্রার্থী করেনি। বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস দল ছেড়ে যোগ দেন বিজেপিতে।
বনগাঁ মহকুমার চারটি এবং হাবড়া, অশোকনগর, স্বরূপনগর বিধানসভা আসনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে মতুয়া সমাজের ভোট বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে বেশিরভাগ মতুয়া ভোট যেত তৃণমূলের ঝুলিতে। লোকসভা ভোটে সেই মতুয়ারাই শাসক দলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ক এ বার ফিরিয়ে আনতে চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে চাপানউতোর চলেছে বিজেপি-তৃণমূলের।
বনগাঁ উত্তর বিধানসভার দু’বারের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস-সহ পুরসভায় কয়েকজন তৃণমূল কাউন্সিলর লোকসভা ভোটের পরে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন। তৃণমূল এ বার এখানে প্রার্থী করেছে জেলাপরিষদ সদস্য শ্যামল রায়কে। তাঁর প্রার্থিপদ পরিবর্তনের দাবিতে বনগাঁ শহরে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা দু’দফায় মিছিল, পথ অবরোধ করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, পুরপ্রশাসক শঙ্কর আঢ্যকে প্রার্থী করা হোক। গাইঘাটা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে মতুয়া ধর্মপ্রচারক নরোত্তম বিশ্বাসকে। সাংবাদিক বৈঠক করে প্রাক্তন সাংসদ মমতা ঠাকুর আবার তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছিলেন। মমতাকে তাঁর হয়ে প্রচারে দেখা যায়নি। প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেছেন তৃণমূল নেতা ধ্যানেশনারায়ণ গুহ। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী আলোরানি সরকারের বাড়ি কাঁচরাপাড়ায়। তাঁকে নিয়েও দলের একাংশের ক্ষোভ রয়েছে।
গাইঘাটা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের দাদা সুব্রত ঠাকুর। তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে আবার বিজেপির একাংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। বাগদা কেন্দ্রে বিজেপি এ বার প্রার্থী করেনি দু’বারের বিধায়ক দুলাল বরকে। ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন দুলাল। পরে অবশ্য বিজেপি প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের হয়ে তাঁকে প্রচারে দেখা গিয়েছে। সংযুক্ত মোর্চার লক্ষ্য লোকসভা ভোটে চলে যাওয়া ভোট ব্যাঙ্ক ফিরিয়ে আনা। গাইঘাটা কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী করেছে মতুয়া গবেষক কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে। তিনি ২০১৬ সালে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। মোর্চার সভা সমিতিতে ভিড় হয়েছিল প্রচুর। যা আশা জাগাচ্ছে নেতৃত্বকে।
ইছামতী, যমুনা নদীর সংস্কার, যশোর রোড সম্প্রসারণ, বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছনো, আর্সেনিক সমস্যা, যানজট, বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া, আমপান দুর্নীতির মতো বিষয়গুলি প্রচারে উঠে এসেছিল এ বার।
ভোটযুদ্ধে এ বার নজর কেড়েছে হাবড়া। এখানে তৃণমূল প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। অন্য দিকে লড়ছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তৃণমূলের খাসতালুক হাবড়া কেন্দ্রে লোকসভা ভোটে দল পিছিয়ে ছিল ১৯,০৫০ ভোটে। হাবড়া পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডেই পিছিয়ে পড়ে তৃণমূল।
লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পর থেকে জ্যোতিপ্রিয় জনসংযোগ বাড়িয়েছিলেন। মাটি কামড়ে ছিলেন ভোট ঘোষণার আগে থেকেই। রাহুল প্রার্থী হওয়ায় বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে গতি এসেছিল প্রচারে। মতুয়াদের মন জয় করতে ডঙ্কা বাজাতে দেখা গিয়েছে প্রার্থীদের। যানজট, নিকাশি, পানীয় জলের সমস্যা সমাধানের আশায় এ বার ইভিএমে মত জানাবেন এখানকার ভোটারেরা। অশোকনগরে বিদায়ী বিধায়ক ধীমান রায়কে দল প্রথমে প্রার্থী করলেও পরে প্রার্থী করা হয় জেলা তৃণমূল কোঅর্ডিনেটর নারায়ণ গোস্বামীকে। এরপরে প্রচারে গতি আসে। ধীমানকে অবশ্য প্রচারে দেখা যায়নি। নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর সুময় হীরা। আইএসএফ প্রার্থী তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে এখানে প্রচারে নজরকাড়া সাড়া পড়ে। আব্বাস সিদ্দিকীও এসেছেন প্রচারে।
স্বরূপনগরে বিধায়ক বীণা মণ্ডল জেলা পরিষদের সভাধিপতিও বটে। তিনি ফের লড়ছেন এই কেন্দ্রে। বল্লির বিলের উন্নয়নের পুরনো প্রতিশ্রুতি এ বারও ফিরে এসেছে বিভিন্ন দলের প্রচারে। বিজেপি প্রার্থী বৃন্দাবন সরকার এ রাজ্যে এ বার তরুণতম প্রার্থী। তাঁকে ঘিরে দলের অন্দরেও আশা অনেক। বামেদের হয়ে লডছেন সিপিএমের বিশ্বজিৎ মণ্ডল। সীমান্ত সুরক্ষা উঠে এসেছে সব দলের প্রচারে। আর্সেনিক সমস্যা সমাধানেও মিলেছে দেদার প্রতিশ্রুতি। বিভিন্ন ভোটে বার বার রাজনৈতিক অশান্তি ছড়িয়েছে আমডাঙা। তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে মোর্তাজা হোসেনের নাম ঘোষণার পরে দলের অন্দরে বিদ্রোহ ছড়ায়। পড়ে প্রার্থী করা হয় গত দু’বারের বিধায়ক রফিকুর রহমানকেই। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে প্রচারে গতি আসে এর পরে। প্রচারে ভাল ভিড় টেনেছেন আইএসএফ প্রার্থী জামালউদ্দিনও। বিজেপি প্রার্থী জয়দেব মান্না আগে ছিলেন তৃণমূলে। তাঁর হয়ে এখানে প্রচারে এসেছেন দলের হেভিওয়েটরা। এসেছেন স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীও। পুরনো কংগ্রেসের গড় হিসেবে পরিচিত বাদুড়িয়ায় এ বার প্রার্থী সে দলের আব্দুস সাত্তার। তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন কংগ্রেস ছেড়ে আসা আব্দুর রহিম দিলু। ইছামতী নদীর সেতুর দাবি পূরণের লক্ষ্যে ভোট দেবেন এখানকার নাগরিকেরা। বিজেপির প্রার্থী সুকল্যাণ বৈদ্য।