তিনি বলতেন, যা কাজ করে দিয়েছি, চারশো বছরেও কেউ করতে পারবে না! সেই তিনিই এখন দোষ-ত্রুটির জন্য করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন জনতার কাছে! দিনকয়েক আগে উড়ালপুল ভেঙে প্রাণহানির পরেও যিনি পুরনো বাম আমলের দিকে আঙুল তুলেছেন, তিনিই এখন বলছেন সব দোষ তাঁর!
রাজ্যে প্রথম পর্বের ভোট মিটতে না মিটতেই সুর আমূল বদলে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের! প্রবল আক্রমণাত্মক মেজাজে সকলের আগে প্রচার শুরু করেছিলেন যিনি, লাগাতার ঘটনার ঝাপ্টায় তাঁর গলাতেই এখন ক্ষমাপ্রার্থনা! পাঁচ বছর আগে দুঃখপ্রকাশের সুর শুনে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কটাক্ষ করতেন তৃণমূলের নেতারা। আর এখন তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য শুনে মজা পাচ্ছে সিপিএম!
নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে আসানসোলের কুলটিতে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ক্ষমা করবেন! দোষ-ত্রুটি সবই আমার। দোষ-ত্রুটি যদি হয়, যদি কখনও ভুল বোঝেন, তা হলে আমার উপরে অভিমান করবেন। মান করবেন! কিন্তু দয়া করে আপনাদের আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা, দোয়া তৃণমূলের মাথা থেকে সরিয়ে নেবেন না! তা হলে আমার পক্ষে পথ চলা মুশকিল হয়ে যাবে!’’ বর্ধমান জেলাতেই অন্য সভায় তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ভুল করলে মানুষকে সংশোধন করার সুযোগ দিতে হয়। সব সময় বলব না, আমি সবজান্তা!’’
শুধু সরাসরিই ক্ষমা চাওয়াই নয়, দুর্নীতির প্রশ্নেও পাল্টা আক্রমণ ছেড়ে এ বার রক্ষণাত্মক ঢঙে ব্যাট করতে দেখা গিয়েছে মমতাকে। নারদ-কাণ্ডের যে ছবিকে তিনি ‘ভেজাল’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এ বার সেই ঘটনাতেও প্রকারান্তরে দোষ কবুল করে ফেলেছেন তিনি! দুর্গাপুরে অন্য একটি সভায় এ দিনই মমতা বলেছেন, ‘‘কখনও এক লক্ষ, দু’লক্ষ, ৫০ টাকার নোট দেখিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে? আর যারা হাজার হাজার টাকা চুরি করে ব্ল্যাকমেলিং করে দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে, সেগুলি কী? যদি কেউ টাকা দিয়েছে, সে-ও অন্যায় করেছে!’’ আপাতদৃষ্টিতে অভিযুক্তদের আড়াল করে স্টিং-কারীদেরই কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি। কিন্তু বিরোধীদের মতে, কেউ টাকা দিলে যদি দোষী হয়, তবে টাকা নিলেও যে দোষ— সেই সত্যও ঘুরিয়ে স্বীকার করা হয়ে গিয়েছে মমতার মন্তব্যে! একই সঙ্গে মমতা আবার এটাও বোঝানোর
চেষ্টা করেছেন যে, আসলে ওটা ঘুষ নয়। অনুদান!
প্রশ্ন হল, কেন এমন সুর বদল তৃণমূল নেত্রীর? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সিংহভাগেরই মত, এ আসলে পর্বতপ্রমাণ চাপের পরিণাম! নারদের গোপন ক্যামেরায় নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, গোপন ক্যামেরার সামনে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী বা সৈয়দ হোসেন মির্জার মতো পুলিশ-কর্তার বিস্ফোরক কথোপকথন প্রতিদিন নয়া বিড়ম্বনা নিয়ে আসছে। গোদের উপরে বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে একটি চ্যানেলের ক্যামেরায় বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের সিন্ডিকেট নিয়ে স্বীকারোক্তি! তার সঙ্গেই আছে উড়ালপুল বিপর্যয়। ঘটনার এই ঘনঘটার জেরে জনমানসে শাসক দল সম্পর্কে ক্ষোভ চড়ছে বুঝেই মমতা ক্ষমা চাওয়ার রাস্তায় গিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা।
এই মতালম্বীরা আরও বলছেন, বাম ও কংগ্রেসের জোট এখন তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। গোড়ায় কটাক্ষে উড়িয়ে দিলেও মমতা এখন বুঝছেন, খেলা অত সহজ নয়! তাই ‘সব করে দিয়েছি’র সুর ছেড়ে এখন ‘ভুল হলেও দেখবেন’-এর মোড়কে চলে যেতে হয়েছে তাঁকে! যদিও মমতা নিজে ক্ষমা চাইলেও তাঁর দলের অস্বস্তি বিন্দুমাত্র কমছে না। সব্যসাচী যেমন এ দিনই নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে দাবি করেছেন, ‘‘ভুল তো কিছু বলিনি! এমন কোনও দল আছে কি, যারা সিন্ডিকেট ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে?’’
বিরোধীরা স্বভাবতই মনে করছে, ক্ষমা চেয়েও আখেরে দলের দোষ-ত্রুটি আড়াল করতে পারবেন না মমতা। পাশাপাশিই কেউ কেউ বলছেন, তৃণমূল নেত্রী কখন কী বলেন, এমনিতেই তার ঠিক নেইউল্টে নানা ঘটনায় গোটা দলটাই দিশাহারা। তাই কে কখন কী বলে ফেলছেন, তার এখন আরওই কোনও হিসেব নেই! মমতার প্রসঙ্গ টেনেই কেউ কেউ বলছেন, কুলটিতে গিয়ে তিনি ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন ঠিকই। এর পরেই অনুব্রত মণ্ডলের এলাকায় গেলে আবার হয়তো আগামী কালই ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়া’র হুঁশিয়ারি দিয়ে আসবেন!
তৃণমূলের একাংশের আবার ব্যাখ্যা, বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলে জোটের প্রভাব ভাল। তা ছাড়া, কুলটিতে এর আগে অবাঙালি সম্প্রদায়কে ‘মেহমান’ বলে মন্তব্য করে বিতর্ক বাড়িয়েছিলেন মমতা। সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টায় তাঁর এ দিনের মন্তব্য হতে পারে। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতা আরও বলছেন, ‘‘দিদি বলছেন ২৯৪টি কেন্দ্রেই তাঁকে দেখে ভোট দিতে। তিনিই বলছেন, দোষ হলে সব তাঁর। তার মানে নিজের কাঁধে সব দায়িত্ব তুলে নিয়ে তিনি ভোটটা উতরোতে চাইছেন।’’
বিরোধীরা অবশ্য মমতার ক্ষমার সুরে ভুলছে না! সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না! প্রথমে হুমকিতে কাজ হচ্ছে না দেখে এখন ক্ষমার কৌশল নিয়েছেন!’’ তাঁর প্রশ্ন, অন্যায়ের জন্য সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী হলে নারদ বা সিন্ডিকেট, সব ঘটনাতেই অভিযুক্তদের আড়াল করলেন কেন? কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘উনি এখন ভয় পেয়েছেন। তাই অভিযুক্তদের আড়াল করছেন আবার মানুষকে বোকা বানাতে ক্ষমাও চাইছেন!’’
আরও পড়ুন...
প্রথম দফার ভোট বাড়ল সাড়ে তিন শতাংশ, ভূতের উপদ্রব?