ভোট ঘোষণার আগেই শুরু হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল। নির্বাচনের দিনক্ষণ জানানোর পরে কমিশনের ‘ফুল বেঞ্চ’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের পর্যবেক্ষকের আগমনে সরগরম রাজ্য। কিন্তু ভোটের দোরগোড়ায় এসে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, এত কিছু করেও কাজের কাজ কতটা হচ্ছে? না হলে এ মাসের গোড়ায় প্রকারান্তরে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেও এত দিনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? অনুব্রত মণ্ডলরাই বা ‘নিশ্চিন্তে ভোট করানো’ নিয়ে লাগাতার বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন কীসের জোরে?
ভোট অবাধ, সুষ্ঠু করতে তাঁরা সব রকম ব্যবস্থা করবেন বলে বারংবার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। যে সব আইপিএস, আইএএসের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ ছিল, তাদের কাউকে কাউকে সরানোও হয়েছে। তবে বিরোধীদের বক্তব্য, এখনও এমন জনা কয়েক শাসক-ঘনিষ্ঠ আমলা রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তা হলে কমিশনের উপরে কী ভাবে ভরসা রাখব, প্রশ্ন তাঁদের।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেখা গিয়েছে, বরাবরই নির্বাচন কমিশনকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে, এক বছর পরে লোকসভা ভোটে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে বিঁধে প্রচার করেন তিনি। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি। ভোট ঘোষণার পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী তো তিন দিনের জন্য। ভোটটা হয়ে গেলে চলে যাবে। তার পর তো আমাদেরই দেখতে হবে!’’ এর কিছু দিন পরে এক জনসভায় বলেন, ‘‘ভোটের পরে আমাদের হাতেই ক্ষমতা আসবে। তখন কমিশন কী করবে?’’
বিরোধীদের বক্তব্য, এ সব তো প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি! এর পরে কমিশনের কাছে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও তাদের উচ্চবাচ্য নেই। যা দেখেশুনে সিপিএম নেতা রবীন দেবের আশঙ্কা, ‘‘২০১৪ সালের মতো এ বারেও কমিশন মমতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ভরসা রাখব কী করে?’’ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘অভিযোগের সারবত্তা থাকলে তিনি যে-ই হোন, ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরে গিয়ে বৃহস্পতিবারই বামফ্রন্ট দাবিপত্র দিয়ে বলেছে, ‘মহম্মদ সেলিম ও অন্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন নোটিস পাঠালেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে বহু আগে থেকে করা অভিযোগের কী হল — তা আমরা জানতে পারলাম না। কমিশনকে স্বচ্ছ হতে হবে।’
এখানেই উঠছে নতুন অভিযোগ। বিরোধী নেতারা বলছেন, এর ফলে অন্য বার্তা যাচ্ছে নিচুতলায়। যার ফলে অনুব্রত মণ্ডল একই কথা বারবার বলে চলেছেন। বিরোধীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এক বার কমিশন তাঁকে শো-কজ করেছে। সেই সংক্রান্ত জবাবে তারা সন্তুষ্টও নয়। তা হলে তার পরেও একই কথা বলার সাহস কী ভাবে পান কেষ্ট? বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কি দলের উপরতলা থেকে তাঁকে বরাভয় দেওয়া হয়েছে— যা মনে হচ্ছে, করে যাও, কেউ কিছু করবে না!
এ দিন কী বলেছেন অনুব্রত? এলাকায় এক কর্মিসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমি বলে দিচ্ছি, সাঁইথিয়ায় ৬০-৭০ হাজার লিড চাই। কোনও বাঘের আওয়াজ হবে না, কোনও সিংহের আওয়াজ হবে না! আপনারা পুরসভায় ভোট করেছেন, পঞ্চায়েত ভোট করেছেন। তার কৌশল জানেন। কোনও চিন্তা করবেন না!’’ বিরোধী নেতাদের একাংশ বলছেন, এটা শুধু কেষ্টর একার কথা নয়। এমন কৌশল নিচ্ছেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী যেমন এর মধ্যে বলেছেন, তাঁদের হাতে লোকজন আছে। কী ভাবে ভোট করাতে হয়, তাঁরা জানেন!
শাসক দলের তরফে যত এমন সব মন্তব্য বাড়ছে, ততই দু’বছর আগের স্মৃতি তাড়া করছে বিরোধীদের! তাদের অভিযোগ, সে বার কমিশনের পর্যবেক্ষকদের নানা উপায়ে ‘হাতে রেখে’, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে প্রায় দর্শক করে রেখে ইচ্ছেমতো ভোট করিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। পুরভোটে দায়িত্ব থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য প্রশাসনের উপরে। কাজেই সেই ভোট নিরপেক্ষ হবে, এমন আশা প্রায় ছিলই না বিরোধীদের। কিন্তু বিধানসভা ভোটের আগের ছবি তাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলছে। তাঁদের প্রশ্ন, এ বারেও একই ঘটনা ঘটবে না তো?
রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসার দিব্যেন্দু সরকারের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের কাছে অভিযোগ এলে দিল্লিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠিয়ে দিই। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি নিয়েও একই পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’ কিন্তু রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী দফতর কিংবা রিটার্নিং অফিসারেরা তো ‘বিধিভঙ্গ’ হলে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারে। সেলিমের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে। তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে অন্য রকম কেন? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে দিব্যেন্দুবাবুর বক্তব্য, ‘‘রিটার্নিং অফিসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ঠিকই, তবে সব অভিযোগ ও তথ্য দিল্লিতে কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত তারাই নেয়।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘কমিশন যখন আইপিএস, আইএস-দের সরায়, তখন তারা খুব ভাল। এখন আবার কমিশনকে দুষছে। ওরা আদালত আর কমিশন নিয়ে থাকুক! আমরা জনতার আদালতে আছি!’’