চোখের ছানি অস্ত্রোপচার করানোর পর আপাতত কাঁথির ‘শান্তিকুঞ্জে’ ঘরবন্দি বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারী। কিন্তু ভোটের ময়দানে ছেলেকে (শুভেন্দু অধিকারী) ‘রাজনৈতিক আক্রমণ’ করলে ছেড়ে কথা বলবেন না। বুধবার সকালে তেমনই জানালেন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘আপাতত ঘরেই আছি। ছেলেরা বলেছে ঘরে থাকতে। কিন্তু ছেলেকে আক্রমণ করলে ছেড়ে কথা বলব না!’’
মাত্রই কয়েকদিন আগে চোখের ছানি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে অশীতিপর রাজনীতিকের। তার আগেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন পুত্র শুভেন্দু। দাদার পথে হেঁটে তার অব্যবহিত পরে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন আরেক পুত্র সৌম্যেন্দুও। অন্য ছেলে দিব্যেন্দু এখনও তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও দলের দূরত্ব ক্রমবর্ধমান। হাসপাতাল ও কলেজ পরিচালন সমিতির মতো বিভিন্ন সরকারি পদ থেকে ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। শুভেন্দু বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পর শিশিরকেও সরানো হয়েছে জেলা তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে। তৃণমূলের বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে তাঁকে এখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি কোনওটিতেই যাননি। বস্তুত, চোখে অস্ত্রোপচারের কারণে শিশির ইদানীং বাড়ি থেকেই বিশেষ বেরোচ্ছেন না। এ-ও এখনই বলে দেওয়া যায় যে, ভোটের প্রচারেও তাঁকে দেখা যাবে না। একদিকে শরীর অসুস্থ থাকার কারণ আর অন্যদিকে বর্তমান দলের সঙ্গে ক্রমশ বাড়তে-থাকা দূরত্ব। ফলে বিধানসভা ভোটে শিশির তৃণমূলের হয়ে প্রচারে নামলে অবাকই হতে হবে।
বুধবার সকালে আনন্দবাজার ডিজিটালকেও তেমনই জানিয়েছেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এখন বাড়িতেই আছি। চোখের অপারেশনটা ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার স্নানও করেছি।’’ তিনি কি বিধানসভা ভোটের প্রচারে বেরোবেন? শিশিরের জবাব, ‘‘ছেলেরা এখন বাড়িতেই থাকতে বলেছে। তাই কোথাও বেরোব না।’’ তার পর সামান্য থেমে, ‘‘তবে আমার ছেলেকে আক্রমণ করলে ছেড়ে কথা বলব না!’’ ছেলে বলতে যে তিনি শুভেন্দুকেই বোঝাচ্ছেন, তা-ও জানিয়েছেন প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তবে ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে শিশিরের ‘অবস্থান’ ক্রমেই আরও ‘স্পর্শকাতর’ দিকে যাচ্ছে। কারণ, তাঁর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে এবার ভোটের প্রার্থী হচ্ছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা শুভেন্দুর পুরোন বিধানসভা কেন্দ্র। বিজেপি মহলের জল্পনা, এবারেও শুভেন্দুকে নন্দীগ্রামেই দাঁড় করানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরাসরি লড়াই হবে মমতা-শুভেন্দুর। অর্থাৎ, সেই লড়াইয়ে একদিকে থাকবেন শিশিরের দলীয় নেত্রী। অন্যদিকে শত্রুপক্ষে যোগ-দেওয়া তাঁর আত্মজ। যে লড়াইয়ে যুযুধান দু’পক্ষ একে-অপরকে ছেড়ে কথা বলবে না।
ভোটের প্রচারে নন্দীগ্রামে এসে মমতা যে শুভেন্দুকে ছেড়ে কথা বলবেন না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তা হলে কি শিশির ময়দানে নেমে দলনেত্রীর সেই আক্রমণের সরাসরি মোকাবিলা করবেন? আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে এখনই তো ভাঙলেন না প্রবীণ। হাসতে হাসতে তার মন্তব্য, ‘‘দেখা যাক! যে ভাষায় আমার পরিবারকে দিনের পর দিন ইতিমধ্যেই আক্রমণ করা হয়েছে, তাতে মনে হয় সেই ধার আরও বাড়বে। তখন হয়তো আমাকে ময়দানে নামতে হবে।’’ প্রসঙ্গত, এর আগেও আনন্দবাজার ডিজিটালকে শিশির বলেছিলেন, ‘‘চেনটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এখন শুধু গলায় বকলসটা আটকে আছে।’’ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি এখনও দলের ‘একনিষ্ঠ সৈনিক’। মমতা এখনও তাঁর ‘নেত্রী’। কিন্তু তাঁর মন আর সেখানে বাঁধা নেই। তবু তাঁকে দলের শৃঙ্খলা মেনে চলতে হচ্ছে। পাশাপাশিই, শিশিরের হৃদয়ে রয়েছে তাঁর পুত্র। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে আক্রমণ বা শুভেন্দুর পরাজয়ও মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। ঠিক ‘মহাভারত’-এর ভীষ্মের মতো। আছেন কৌরবদের দলে। মন পড়ে রয়েছে পাণ্ডবদের হিতাকাঙ্ক্ষায়। ‘ধর্মযুদ্ধে’ প্রবল টানাপড়েন।
হাসছেন বটে। কিন্তু রাজনীতির টানাপড়েনে আছেন একাশি বছরের শিশির। ‘শান্তিকুঞ্জে’ আগের মতো শান্তি নেই।