ডেরেক, সুব্রত, সুদীপের সঙ্গে তৃণমূল ভবনে যশবন্ত।
বিজেপি ছাড়ার তিন বছরের মাথায় তৃণমূলে যোগ দিলেন যশবন্ত সিন্হা। এই প্রথম বিজেপি-র জাতীয় স্তরের কোনও নেতা তৃণমূলে যোগ দিলেন। বরাবরই নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের সমালোচক হিসেবে পরিচিত তিনি। শনিবারও তার অন্যথা হয়নি। তৃণমূল ভবনে জোড়াফুলের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বিজেপি-র তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। মোদী-শাহের হাতে পড়ে বিজেপি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন। দিল্লি থেকে বসে মোদী-শাহ দেশে স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছেন বলেও দাবি করেন।
শনিবার তৃণমূল ভবনে যশবন্তকে দলে যোগ দেওয়ান সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরে সুব্রত বলেন, “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ যশবন্তকে স্বাগত জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য আসতে পারেননি। তবে যশবন্তের মতো নেতাকে দলে পেয়ে তৃণমূল আরও সমৃদ্ধ হল।” তবে তৃণমূল মন্ত্রী সশরীরে আসতে না পারলেও, ফোনে যশবন্তের সঙ্গে ৪৫ মিনিট তাঁর কথা হয়েছে বলেও জানান সুব্রত। নীলবাড়ির লড়াইয়ে যশবন্তের তৃণমূলে যোগদান দলের পক্ষে ইতিবাচক হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
১৯৮৪ সালে জনতা দলের হাত ধরে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়া যশবন্ত বরাবরই গেরুয়া শিবিরের অংশ ছিলেন। তিনি বিজেপি-র মুখপাত্রও ছিলেন এক সময়। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে অর্থ এবং বিদেশমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও সামলেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের হাতে দলের রাশ ওঠার পর থেকেই বিজেপি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে যশবন্তের। মোদী-শাহের হাতে বিজেপি-র চিন্তা-ভাবনা গণতন্ত্র বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে একাধিক বার অভিযোগ করেন তিনি। মোদী-শাহের হাতে পড়ে দল শুধু মাত্র দুই-ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেন। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে বিজেপি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তবে তাঁর ছেলে জয়ন্ত সিন্হা এখনও বিজেপি-তেই রয়েছেন। লোকসভার সাংসদ তিনি।
শনিবার তৃণমূলে যোগ দিয়েও মোদী-শাহের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন যশবন্ত। তৃণমূল ভবনে তিনি বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন, দলগত রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর এই বয়সে ফের সক্রিয় রাজনীতিতে আসার কী এমন দরকার পড়ল। আমার মতে, বর্তমানে দেশ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এত দিন যে মূল্যবোধ নিয়ে চলতাম আমরা, যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম, তা আজ বিপদের সম্মুখীন। সমস্ত মূল্যবোধ ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন কেউ মানছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রতার উপরই গণতন্ত্রের শক্তি নিহিত থাকে। কিন্তু আজকের দিনে সমস্ত প্রতিষ্ঠানই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত আফসোসের সঙ্গে মানতে হচ্ছে, দেশের বিচারব্যবস্থাও এর মধ্যে পড়ছে। বর্তমান সরকার নিজের মর্জিমতো চলছে। বিরোধিতা করার কেউ নেই। গণতন্ত্রের অর্থ শুধু পাঁচ বছর অন্তর ভোট করানো নয়, জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার দায়ও বর্তায় নির্বাচিত সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের উপর। কিন্তু বর্তমানে এ সবের ধার ধারছেন না কেউ। তাই অন্নের জোগান দেওয়া কৃষকরা দিল্লির রাস্তায় পড়ে থাকলেও মাথাব্যথা নেই কারও।’’
বাজপেয়ী জমানার সঙ্গে মোদী সরকারের তুলনা টেনে যশবন্ত বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষকে নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই বর্তমান সরকারের। যেন তেন প্রকারে ভোটে জেতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। অটলজির সরকারে কাজ করেছি। তখনকার সময় দল যা ছিল, আজকের সঙ্গে তার আকাশ-পাতাল তফাত। অটলজি সর্বসম্মতিতে বিশ্বাস করতেন, আজকের সরকার বাকিদের পদদলিত করতে চায়। অটলজি সকলকে সহযোগিতা করতেন, আজকের সরকার শুধু নিজের জয় হাসিল করতে চায়। জম্মু-কাশ্মীরের ফারুখ আবদুল্লা, শিবসেনা, নীতীশ কুমার, মমতাজি, হরিয়ানার চৌটালা, অকালি দলকে নিয়ে জাতীয় জোট গড়ে তুলেছিলেন অটলজি। আজ দেখুন শিবসেনা, বিজেডি, অকালি দল সকলে জোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। পুরনোদের মধ্যে শুধু নীতীশ কুমারই রয়ে গিয়েছেন। আসলে এই বিজেপি কারও বন্ধুত্বের যোগ্যই নয়।সামনে অনেক বড় লড়াই। শুধু রাজনীতি বা ভোটের লড়াই নয়, দেশের অস্মিতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সকলকে একজোটে এগিয়ে আসতে হবে।’’
এই মুহূর্তে গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী শিবিরের অন্যতম নেত্রী মমতা। দীর্ঘ দিন যশবন্তের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতার ভূয়সী প্রশসাংও করেন যশবন্ত। তিনি বলেন, ‘‘মমতাজি আর আমি দু’জনেই অটলজির সরকারে কাজ করেছি। শুরু থেকেই যোদ্ধা উনি। কন্দহর বিমান ছিনতাই নিয়ে যখন মন্ত্রিসভায় বৈঠক চলছে, সেই সময় নিজেকে পনবন্দি করে জঙ্গিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন মমতাজি। বলেন, বাকিদের মুক্তির বিনিময়ে নিজেকে জঙ্গিদের হাতে তুলে দেবেন। দেশের জন্য এই আত্মত্যাগে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। আজকের দিনে এই মানসিকতাই প্রয়োজন। বাংলার নির্বাচন নিছক ভোটের লড়াই নয়, এই লড়াই গোটা দেশকে বার্তা পৌঁছে দেবে যে, আর অন্যায়, স্বেচ্ছার সহ্য করা হবে না। দিল্লিতে বসে মোদী-শাহ যা করছেন, তার বিরুদ্ধে বাংলাতেই প্রথম পরীক্ষা। গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, আজ বাংলা যা ভাবে, দেশ তা ভাবে কাল। তাই শুধুমাত্র বাংলার ভবিষ্যতের জন্য নয়, গোটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪-এ দিল্লিতে পরিবর্তনের রাস্তাও বাংলা থেকেই প্রশস্ত হবে।’’
আসন্ন নির্বাচনে দলের হয়ে যশবন্ত কী ভূমিকা পালন করবেন, তৃণমূলের তরফে তা এখনও স্পষ্ট ভাবে জানানো হয়নি। তবে যশবন্তকে এনে বাংলার হিন্দিভাষী মানুষদের কাছে বার্তা দেওয়া হল বলে মনে করছে দলেরই একাংশ। হিন্দিভাষীদের কাছে প্রচারেও তাঁকে নামানো হতে পারে। কারণ শনিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে দলে যোগ দিলেও, মমতার সঙ্গে বরাবরই সুর-তাল মেলে যশবন্তের। বিজেপি ছাড়ার পর ২০১৯-এ বিজেপি বিরোধী সর্বদলের ব্রিগেড সমাবেশে মমতার কথাতেই হাজির হয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ই জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপি মুক্ত ভারত গড়াই তাঁর জীবনের শেষ লড়াই।