দেওয়াল জুড়ে: বিষ্ণুপুরের কবিরাজপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র।
প্রান্তরের শেষে প্রকাণ্ড মুষ্টিবদ্ধ হাত। নিশান হাতে সে দিকে চলেছে ছোট্ট মেয়েটি। পাশে বই কাঁখে ছোট একটি ছেলে। পিছনে কাস্তে আর ধানের বোঝা হাতে প্রচুর মানুষ। সাদা-কালো ছবির উপরের আকাশটুকু শুধু লাল। আর দোতলার বারান্দায় ঝোলানো কাপড় পাঁচিলের সেই আকাশ ছুঁয়ে শুকোচ্ছে চৈত্রের রোদে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে এমন দৃশ্যের সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছেন পথচলতি অনেকেই।
এ বার বিধানসভা ভোটে রাজ্যের ১২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে সিপিআই(এমএল)। দলের দুই শিল্পী, অনুপম রায় ও জিৎ নট্ট কেন্দ্রগুলিতে ঘুরে ঘুরে দেওয়াল লিখে চলেছেন। জিৎ জানান, মার্কসবাদী শিল্পী চিত্তপ্রসাদের শৈলী তুলে ধরছেন তাঁরা।
এ বার ভোটে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ছড়িয়ে যাচ্ছে নানা রকমফেরে। সে ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে দেওয়াল কতটা গুরুত্বপূর্ণ? অনুপম বলেন, ‘‘আইটি সেল দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দখল নিতে চাইছে কোনও দল। কোনও দল কর্পোরেটকে দিচ্ছে প্রচারের ভার। এ রকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে দেওয়াল পুনরুদ্ধার করাটা জরুরি।’’
দুই শিল্পীর মতে, লকডাউনের মতো কঠিন সময় পার করে এসে চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন বা সোমনাথ হোড়ের মতো শিল্পীদের কাজ নতুন করে তুলে ধরার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। অনুপম বলেন, ‘‘মার্কসবাদী শিল্পীরা ক্রমশ গ্যালারিতে বন্দি হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের অধিকার মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।’’
চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষ ও বন্যাপীড়িত মেদিনীপুরকে লেখায়-রেখায় নথিবদ্ধ করেছিলেন। এঁকেছেন তেভাগা আর তেলঙ্গানার কৃষক আন্দোলনের কথা। তাঁর ছবির অন্যতম পরিচিত মাধ্যম ছিল লিনোকাট। জিৎ জানান, লিনোকাটের ধাঁচেই তাঁরা রং-তুলি দিয়ে দেওয়াল আঁকছেন।
বাঁকুড়া জেলার ওন্দা ও রাইপুরে সিপিআই(এমএল)-এর প্রার্থী রয়েছেন। কিন্তু জিৎরা দেওয়াল-এঁকেছেন বিষ্ণুপুর শহর-সহ আরও জায়গায়। তাঁদের দাবি, ‘‘এটা শুধু দলের হয়ে ভোটের প্রচার নয়। মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করাও।’’
অনুপমের বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরের কাঁকপুলে, জিতের কল্যাণগড়ে। বাঁকুড়ার পাট চুকিয়ে এখন তাঁরা মুর্শিদাবাদে ভুষোকালি, চুন আর লাল রঙ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। জানান, বাঁকুড়ায় আঁকতে সাহায্য করেছেন দলের বিষ্ণুপুরের সদস্য তিতাস গুপ্ত, ফারহান খান, শুভম দের মতো অনেকে।
বিষ্ণুপুরের কবিরাজপাড়ায় অনুপমদের একটি দেওয়াল-চিত্র রয়েছে। চাকরির খোঁজে থাকা স্থানীয় যুবক সায়ন্তন রায় ও বিল্টু ক্ষেত্রপাল বলেন, ‘‘সাধারণ দেওয়াল লিখনের সঙ্গে এর স্পষ্ট তফাত আছে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর ভাল লাগে না। এ রকম ছবি দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।’’ ওন্দার ধনঞ্জয় কিস্কু ও লালমনি মান্ডির কথায়, ‘‘আমরা দেওয়ালের লেখা পড়তে পারি না। কিন্তু ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছিল খুব চেনা।’’
পথ আলাদা আলাদা, কিন্তু চোখ গিয়ে পড়ছে দেওয়ালে। আর তাতেই জিৎ-অনুপমদের সাফল্য, মনে করছেন অনেকেই।