পুলিশের তাড়া। কাঞ্চননগরে। ছবি: উদিত সিংহ।
ভোট-পরবর্তী হিংসায় তপ্ত হল বর্ধমান শহর। রবিবার দুপুর থেকে দফায়-দফায় বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষ হয় বর্ধমান শহরের দুই প্রান্ত লক্ষ্মীপুর মাঠ ও কাঞ্চননগরে। মোটরবাইক, বাড়িতে আগুন ধরানোর অভিযোগ উঠল। দলের কর্মীদের মনোবল বাড়াতে গিয়ে ইটবৃষ্টির মুখে পড়ে ছুটতে দেখা গেল বর্ধমান দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থী খোকন দাসকেও। পুলিশের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ ও ‘অসহযোগিতার’ অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। যদিও তা মানেনি পুলিশ।
তৃণমূলের অভিযোগ, শনিবার ভোট মেটার পরে লক্ষ্মীপুর মাঠে তাঁদের কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালায় বিজেপি। ওই সব বাড়ির মহিলাদের অভিযোগ, শনিবার রাত ৮টা নাগাদ ১০-১৫ জনের একটি দল প্রথমে লাঠি, শাবল-সহ নানা অস্ত্র নিয়ে পাড়ায় চক্কর দেয়। তার পরে হুমকি দেয়। শেষে হামলা চালায়। এর পরেই রাত সাড়ে ৯টা থেকে ‘বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের’ গ্রেফতারের দাবিতে তৃণমূল প্রার্থীর নেতৃত্বে থানা ঘেরাও হয়। বিসি রোডের উপরে শুয়ে পড়ে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা বিক্ষোভ দেখান। পুলিশের আশ্বাসে গভীর রাতে ঘেরাও ওঠে।
তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, সোমবার দুপুরে দলের কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য লক্ষ্মীপুর মাঠে ভাঙচুর হওয়া বাড়ি দেখতে যান খোকনবাবু। তাঁর সঙ্গে শ’দেড়েক কর্মী-সমর্থক ছিল। ভাঙা বাড়িগুলি দেখে লক্ষ্মীপুর মাঠের রেললাইন ধারে জলট্যাঙ্কের দিকে এগোতেই এক দল মহিলার সঙ্গে বচসা বেধে যায় তৃণমূল কর্মীদের। সেখানে এক কর্মীকে ঘিরে ধরে মারধর করা হয়। তৃণমূল কর্মীরা পাল্টা লাঠি হাতে যেতেই রেললাইনের ধার থেকে ইট-পাথর ছোড়া হয়, লাঠি-হাঁসুয়া নিয়ে মহিলারা তাড়া করে বলে অভিযোগ। তৃণমূলের লোকজন দৌড়ে জিটি রোডে রেল উড়ালপুলের নীচে চলে যান। স্থানীয় সূত্রের দাবি, খোকনবাবুকেও ছুটতে দেখা যায়।
এলাকার মহিলাদের একাংশের দাবি, বিজেপির এজেন্ট হওয়ার জন্য আমাদের পাড়ার সিদ্ধার্থ মণ্ডলকে শনিবার সন্ধ্যায় মারধর করা হয়েছে। তাঁর চোখে গুরতর চোট লেগেছে। এর পরে রবিবার দুপুরে তৃণমূল ‘বহিরাগত’দের নিয়ে হামলা চালায়। তাতে শিশু, বালিকা থেকে
অনেকেই জখম হয়েছেন বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে এলাকায় পৌঁছন বর্ধমানের আইসি পিন্টু সাহা-সহ পুলিশ ও র্যাফের বাহিনী। লক্ষ্মীপুর মাঠ এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই কাঞ্চননগরে অশান্তির খবর মেলে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কাঞ্চননগরের বেলপুকুরে স্থানীয় একটি ক্লাবে কয়েকজন তৃণমূলের পতাকা খুলে বিজেপির পতাকা লাগানো, ক্লাবের সাইনবোর্ড খোলার চেষ্টা করে। তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, বাধা দেওয়ার সময়ে বিজেপির ছেলেরা হুমকি দেয়, এখন থেকে সব তাদের দখলে। প্রতিবাদ করতেই মারধর করা হয়। এর মধ্যে তৃণমূলের লোকজন পৌঁছলে গোলমাল বাধে। তখন বিজেপি কর্মীরা রাস্তার ধারে থাকা পরপর মোটরবাইকে আগুন ধরায় বলে অভিযোগ। স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর দাবি, ‘‘বেলপুকুরে কয়েকটি দোকান থেকে পেট্রল নিয়ে এসে তিনটি মোটরবাইক পোড়ানো হয়।’’ পোদ্দারপাড়ায় একটি বাইকে আগুন, এক জনের পায়ে ধারাল অস্ত্রের আঘাত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। তৃণমূলের অভিযোগ, ওই ক্লাবের পাশে থাকা দলের একটি কার্যালয়েও ভাঙচুর চালিয়েছে বিজেপি। খোকন দাসের বাড়িতে ঢুকে বাহিনী লাঠি চালায় বলেও অভিযোগ।
বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, তাঁদের এক সমর্থকের বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। বাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তৃণমূলের লোকেরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে তাদের দাবি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্ধমান সদর) কল্যাণ সিংহ, এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে পুলিশের বড় বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।
তৃণমূল নেতৃত্ব পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। খোকনবাবুর অভিযোগ, ‘‘ভোটের পরে বিজেপি এলাকায় সন্ত্রাস তৈরি করছে। লক্ষ্মীপুর মাঠে ১৫টি বাড়ি-সহ শহরে ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে। ওই সব বাড়ি দেখতে গেলে আমাদের উপরে ইট-বোমা ছোড়া হয়। ছুটে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। কাঞ্চননগরেও দুষ্কৃতীদের জড়ো করে এলাকা অশান্ত করে তুলেছে। সবই হচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য।’’ বিজেপির বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভার আহ্বায়ক কল্লোল নন্দনের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল হার নিশ্চিত বুঝে শহরে গোলমাল পাকাচ্ছে। আমাদের উপরে হামলার চেষ্টা করেছে। আমরাও প্রতিরোধ করেছি।’’
জেলা পুলিশের দাবি, ঘটনার মিনিট দশেকের মধ্যে পুলিশ এলাকায় পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ঘটনায় অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘নিষ্ক্রিয়তা ও অসহযোগিতার অভিযোগ ঠিক নয়।’’