সুজন চক্রবর্তী, দেবব্রত (মলয়) মজুমদার, রিঙ্কু নস্কর
—জিতবেন তো?
হাসিহাসি মুখে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুজন চক্রবর্তী— ‘‘কেন রে, না জিতলে কী হবে?’’ জবাব এল, ক্ষতি হয়ে যাবে।
দু’হাতে অনুজ শুভাকাঙ্ক্ষীর মাথা ঝাঁকিয়ে দিয়ে যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী বললেন, ‘‘নিশ্চিন্ত থাক।’’ কিন্তু তিনি নিজে কি নিশ্চিন্ত? দিনের দ্বিতীয়ার্ধের প্রচারে বেরনোর আগে ফের হাসলেন রাজ্যে পরিষদীয় রাজনীতিতে বামেদের ‘শিবরাত্রির সলতে’। আসলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হারা আসন ফিরিয়ে এনে ২০১৬
সালে বামেদের মর্যাদাও রক্ষা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু সেই লড়াইয়ের থেকে এ বারে তা রক্ষা করার লড়াই কি বেশি কঠিন? বাম-কংগ্রেস আর আইএসএফের জোট যদি ক্ষমতায় না আসে তা হলে যাদবপুরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে লাভ কী? সুজনবাবুর দলের সেই ‘সীমাবদ্ধতা’ বোঝেন মুকুন্দপুরের দোকানি। আপনাদের এমএলএ কাজের? চায়ের দোকান ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁর জবাব, ‘‘শুনেছি, ভাল মানুষ। আমি কখনও যাইনি। আর ওঁরা তো ক্ষমতায় নেই।’’
এ বারের নির্বাচনে যাদবপুরের এই ‘বিচ্ছিন্নতা’ উসকে দিচ্ছে তৃণমূল। উপরে যাদবপুর লোকসভা আর নীচে পুরসভা তাদেরই দখলে। এই বিন্যাসে যাদবপুর হাতছাড়া হওয়া তৃণমূলের কাছে শুধু একটি আসনের হারই নয়, মর্যাদার প্রশ্নও। তাই রাখঢাক না করেই তৃণমূল প্রার্থী দেবব্রত (মলয়) মজুমদার বলছেন, ‘‘সিপিএম এই লড়াইয়ে নেই। ওরা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে তৃণমূলকে হারাতে। তাতে নিজেরা থাকবে না, বিজেপিও জিতবে না।’’ কলকাতার বিদায়ী পুরবোর্ডের কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদের এই পরিচিতিকে সম্বল করে তুলনায় কমবয়সি মলয়কে সামনে রেখে ফের যাদবপুরকে দখলে আনতে চাইছে তৃণমূল। যাদবপুরের এ বারের লড়াইয়ে বিজেপি আলোচনায় এসেছে প্রার্থীর কারণেই। একসময় সিপিএমের পরিচিত মুখ, নবীন কাউন্সিলর রিঙ্কু নস্কর বিজেপিতে যোগ দিয়ে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন। সেই সঙ্গে এ বার বিজেপি যে আবহ তৈরি করতে চেয়েছে তার অঙ্গ হিসেবে যাদবপুরের সর্বত্রও পোস্টার, পতাকায় তাঁর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
এই বিন্যাসে যাদবপুরের লড়াই কি ত্রিমুখী হয়ে উঠতে পারে? তা হলে এ বারের ভোট এখানে আরও একটু টানটান হয়ে উঠতে পারে। সংযুক্ত মোর্চা বা তৃণমূল অবশ্য তা মানতে নারাজ। সুজনবাবুর কথায়, ‘‘আমরা বলছি, তৃণমূল অসহ্য। বিজেপিও সমান ক্ষতিকর। তা ছাড়া ওদের কে কোন দলে আছেন বা থাকবেন, তা-ও নিশ্চিত নয়।’’ তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত সরাসরিই বলছেন, ‘‘সিপিএমকে ভোট দিয়ে লাভ কী? সরকার তো গড়বে তৃণমূল। তাই যাদবপুরকে মূলস্রোতে রাখতে মানুষের কাছে তৃণমূলই প্রথম পছন্দ।’’
তবে আড়ালে আরও একটা হিসেব চলছে যাদবপুরের আসন ঘিরে। বিশেষ করে এই আসনে বিজেপির ‘সম্ভাবনা’য় ভরসা রেখে নিজেদের আসন সুনিশ্চিত করতে চাইছে তৃণমূল। এক সময়ের সিপিএম কাউন্সিলর রিঙ্কু বামপন্থীদের ভোট কেটে সুজনবাবুদের পিছনে ফেলে দেবেন। আর তাতেই তারা যাদবপুর ফিরে পাবেন— এই রকম অঙ্ক কষছেন দেবব্রতও। তাঁর কথায়, ‘‘অন্তত দুটি ওয়ার্ডে বামেদের ভোট বিজেপিতে যেতে পারে।’’
তরজা রয়েছে লকডাউন পরিস্থিতিতে কে মানুষের কাছে বেশি ছিল, তা নিয়েও। সুজন বলছেন, ‘‘যাদবপুরে বামপন্থীদের ক্যান্টিন তো সারা বাংলায় মডেল হয়ে গিয়েছে। সে কাজ তো তৃণমূল করেনি।’’ মলয় পাল্টা বলছেন, ‘‘পাঁচ বছরে বিধায়কের উপস্থিতি কোথায়? কে দেখেছেন তাঁকে?’’
প্রত্যাশিত ভাবে সেই ভাবনা খারিজ করে দিচ্ছে সিপিএম তথা সংযুক্ত মোর্চা। সুজনবাবুর দাবি, ‘‘যাদবপুরের মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান বরাবরই স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রেখেছে। এখানকার মানুষ সঠিক পদক্ষেপ করেন।’’ তৃণমূলের এই হিসেব মানতে রাজি নন রিঙ্কুও। তাঁর কথায়, ‘‘লড়াই তো বিজেপির সঙ্গে ওদের। ফলে কাটাকাটি হলে ওদের মধ্যেই হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ এ সব অঙ্ক কষছে না। মানুষ শুনতে চাইছে জলের সমস্যা কবে মিটবে। কৃষ্ণা গ্লাসের জমিতে কর্মসংস্থান হবে কি না।’’
এটা ঠিক যে গত লোকসভা নির্বাচনে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বিজেপির ভোট। কমেছে বাম- কংগ্রেস জোটের ভোট। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভায় তা হয়েছে ২৪ শতাংশ। বিজেপির এই বৃদ্ধিতে ক্ষতি হয়েছে বামেদেরই। তাদের ভোট কমেছে ১৫ শতাংশ। এই ধারা থাকলে এ বারে বদলের সম্ভাবনা থাকছে যাদবপুরে।
সকালে খবরের কাগজ আর চা নিয়ে এ সব অঙ্ক চলছিল সুকান্ত সেতুর মুখে, চায়ের দোকানে। মাঝবয়সি ভদ্রলোক দুই তরুণকে বলছিলেন, ‘‘লোকসভা আর বিধানসভার ভোট তো এক নয়।’’
পরীক্ষা হয়তো কঠিন। তবে প্রস্তুতি যে যথেষ্ট, শেষবেলার প্রচারে বুধবার বিকেলে রোড শোয়ে সেই বার্তা দিয়েছেন সুজনবাবু।