হোর্ডিং, ব্যানারে লড়াইয়ের আঁচ থেকে গিয়েছে এখনও। তমলুক শহরে। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তরুণ বয়স থেকেই সক্রিয় ভাবে জড়িত রাজনীতিতে। জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা থেকে তিন বারের বিধায়ক। এবারের ভোট যুদ্ধ তাই তাঁর কাছে নতুন নয়। কিন্তু তমলুক বিধানসভায় প্রার্থী হয়ে লড়াই করার পাশাপাশি তৃণমূলের জেলা সভাপতি হিসেবে ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততার মধ্যেই কাটিয়েছেন সৌমেন মহাপাত্র। ভোটগ্রহণ পর্ব মেটার পরেও সেই ব্যস্ততা কমেনি সৌমেনবাবুর।
আদতে পাঁশকুড়া শহরের বাসিন্দা সৌমেনবাবু। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য সৌমেনবাবু ২০১১ সালে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেই মন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে বিধানসভা কেন্দ্র বদলে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা কেন্দ্র থেকে জিতে ফের মন্ত্রী হন। এ বার ২০২১ শে তমলুক বিধানসভায় প্রার্থী তিনি। তবে এ সবের মাঝেই ঘটে গিয়েছে জেলা তথা রাজ্য রাজনীতির সব থেকে বড় দলবদল। পূর্ব মেদিনীপুরের দাপুটে তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী চলে গিয়েছেন বিজেপিতে। শিশির অধিকারীও বেশ কিছুদিন ধরে ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকায় সেই পথে ধরে জেলার রাজনীতিতে ফের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সৌমেনের।
তৃণমূলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পাশাপাশি তমলুক বিধানসভায় প্রার্থী হয়ে লড়াই করছেন সৌমেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী চিকিৎসক হরেকৃষ্ণ বেরা। এবার প্রথম নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে লড়াই করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। গত ১ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় তমলুক সহ জেলার ৯ বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নিজের কেন্দ্রে ভোটের প্রচারের পাশাপাশি জেলার অন্য সমস্ত বিধানসভা কেন্দ্রের সাংগঠনিক দায়িত্ব সামলেছেন সৌমেন। ভোটগ্রহণ পর্বের পরে দলের ব্লক নেতাদের সাথে ভোটপ্রাপ্তির হিসেব কষার পাশাপাশি আক্রান্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের দেখতে যাওয়া ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় গোলমালের ঘটনা নিয়ে প্রশাসনের কাছে নালিশ জানাচ্ছেন। সৌমেনবাবু বলেন, ‘‘প্রার্থী হওয়ার পর সকালে বাড়িতে পুজোপাঠ সেরে প্রচারে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হত। এখনও সকালে বাড়িতে অনেকে আসেন দেখা করতে চিকিৎসায় সাহায্যের জন্য। তাঁদের সাহায্য করা হয়। তারপর স্নান সেরে পুজোপাঠ করে দলের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আক্রান্ত দলীয় কর্মীদের দেখতে যাওয়া, তাঁদের খোঁজ-খবর নেওয়া সহ জেলার অন্যান্য বিধানসভা এলাকা নেওয়া এসবের মধ্যেই দিন কাটছে। আগামী ৯ এপ্রিল থেকে উত্তরবঙ্গে দলের প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে যাব।’’ ভোটের ফল কী হবে? সৌমেনবাবুর উত্তর, ‘‘তমলুকের মানুষ আমাদের বিপুলভাবে সমর্থন করেছেন। আমার জয় নিশ্চিত।’’
সৌমেনবাবুর উল্টোদিকে রয়েছেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির হরেকৃষ্ণ বেরা। ৩০ বছরেরও বেশি চিকিৎসক হিসাবে পরিচিত হরেকৃষ্ণ রাজনীতিতে নবাগত। বছর দেড়েক আগে সক্রিয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তবে ভোটের প্রচারে নিজের চিকিৎসক পরিচয়টাই তাঁর প্রধান সহায়ক হয়েছে বলে মানছেন বিজেপি প্রার্থী। তমলুক শহরের বাসিন্দা হরেকৃষ্ণ বিজেপি প্রার্থী হওয়ার পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচারে জোর দিয়েছিলেন। তবে ভোট প্রচারের শেষদিন ৩০ মার্চ রাতে বিরোধী দলের লোকের হাতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন হরেকৃষ্ণ। তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে বিজেপি। অ্যাম্বুল্যান্সে চেপেই ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন তিনি। তবে এখন বাড়িতে বিশ্রামে রয়েছেন।
প্রথম বার ভোটের লড়াইয়ে নেমে এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে বিজেপি প্রার্থী বলেন, ‘‘প্রার্থী হওয়ার পর প্রথম দু-তিনদিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই প্রচারে বেরিয়েছিলাম। তাতে অনেকে আমাকে চিনতে পারেনি। তারপরে চেম্বারে রোগী দেখার জন্য যে প্যান্ট-শার্ট পরতাম সেই পোশাকে প্রচারে বের হতেই লোকজন অনায়াসেই আমাকে চিনে নিয়েছেন। মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। জেতার বিষয়ে সুনিশ্চিত তো বটেই।’’
তবে অসুস্থ থাকায় চেম্বারে বসতে না পারায় মন খারাপ হরেকৃষ্ণর। বললেন, ‘‘এখনও মাথায় ব্যথা রয়েছে। নিউরোলজিস্টকে দেখিয়েছি। আমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। রোগী দেখার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।’’
সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই প্রার্থী গৌতম পণ্ডা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। দলের শিক্ষক সংগঠনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। ভোটে লড়াই করার অভিজ্ঞতা তাঁরও এই প্রথম। ভোটপরবর্তী সময়ে দলের ও শিক্ষক সংগঠনের কাজে কয়েকদিন ব্যস্ত ছিলেন। তারপর রবিবার থেকে কলকাতায় মোর্চার প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচারে রয়েছে। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘ভোট গণনার বেশ কিছু দিন বাকি থাকায় মাঝে কয়েকদিন দল ও শিক্ষক সংগঠনের কাজ করছিলাম। এখন মোর্চার প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার করছি।’’ গতবার এই কেন্দ্রে বাম- কংগ্রেস জোটের সিপিআই প্রার্থী জিতেছিলেন। এ বাক কী হবে? গৌতমবাবুর মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল, বিজেপি ও মোর্চার প্রার্থীর মধ্যে জোরদার লড়াই হয়েছে। ভাল ফলের আশা করছি।’’
তবে তমলুক বিধানসভার ফল নিয়ে ভোটারদের আলোচনায় তৃণমূল আর বিজেপিই। কারও কথায়, বিজেপির হাওয়া চলছে। তো কেউ তৃণমূলের উন্নয়নের কথা বলছেন। তমলুক শহরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুধাংশু বেরার কথায়, ‘‘ভোটের প্রচারে রাজ্য সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘কন্যাশ্রী’ তৃণমূলের পক্ষে প্রভাব ফেলেছে। পাল্টা বিজেপির হাওয়া থাকলেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অনেকের মনে প্রভাব ফেলেছে।’’ শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের বাসিন্দা নিতাই সামন্ত বলেন, ‘‘ভোটের ফলে শাসক কিংবা বিরোধী যে পক্ষই জয়ী হোক, এলাকার শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় যাতে থাকে তা সব রাজনৈতিক দলের দেখা উচিত।’’
তবে লড়াই যে সহজ হবে না সে ব্যাপারে একমত সব প্রার্থীই।