প্রতীকী ছবি।
একজন পুরসভার চেয়ারম্যান থেকে রাজ্যে তিন দশকের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়ে মেয়র, বিরোধী দলের বিধায়ক হয়ে বৃত্তটা অনেকদিন আগেই সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন। আর একজন, সবে কাউন্সিলর থেকে বিধানসভার ভোটে লড়াইয়ে নেমে দৌড়টা শুরু করেছেন। শহরের অনেকেই কিছুদিন আগেও বলতেন, দ্বিতীয়জন প্রথমজনের ছায়াসঙ্গী। দু’জনকে অনেক সময়ই দেখা যেত একসঙ্গে। করোনা লড়াই থেকে মিছিল, মিটিংয়ে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কথায়, ‘‘শহরে কিছুদিন আগে বর্গী (কৈলাস বিজয়বর্গীয়) এল, অন্দরমহলে কিসের যেন হিসেবনিকেশ হল। আর দু’জন আলাদা হয়ে গেলেন।’’ একজন অশোক ভট্টাচার্য, আর একজন শঙ্কর ঘোষ।
প্রথমজন শিলিগুড়ি বিধানসভার সংযুক্ত মোর্চা এবং দ্বিতীয় জন বিজেপির প্রার্থী। যদিও নিজেরা এখন আর কেউ একে অপরকে গুরু-শিষ্য মানতে পুরোপুরি নারাজ। একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখও খুলছেন না। সকাল থেকে চরকি পাক খেয়ে ঘুরছেন বেশি। তবু শহরে অভিজ্ঞদের মধ্যে আড়ালে আলোচনা চলছে, পুরনো শিষ্য প্রচারে তো দিনরাত এক করে ফেলছেন। কিন্তু পোড়খাওয়া গুরু অশোককে কি আদৌ হারাতে পারবেন? সেই ‘গুরু-মারা’ বিদ্যে কি শিষ্যের জানা আছে?
অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া, শহরের আনাচে কানাচে কয়েক দশকে বরাবর গতিবিধি অশোকের। বাড়ি বাড়ি লোকের নামও প্রায় মুখস্থ। নিজের দলের বাইরে তৃণমূল হোক বা কংগ্রেস বা বিজেপি— কোনও দলের নেতানেত্রী নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ নেই কোনওদিনই। ক্লাব থেকে স্বনির্ভর গোষ্ঠী, অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে সংখ্যালঘু— সকলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। ক্ষমতা থেকে দশ বছর সরে এলেও রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে বিচরণ অব্যাহত। বামেরা বলেন, ভোটের হিসেবটা তিনি নাকি ভালই বোঝেন। ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস জোটের গল্পটা শুরু করাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। শাসক তৃণমূলের নেতারাও আড়ালে বলেন, ‘‘অশোকদার দরজা সবার জন্য খোলা থাকে সারা বছর। এর লাভটা প্রতি বার ভোটে উনি পেয়ে থাকেন। আর এ বার তো বলেই দিয়েছেন, শেষ লড়াই। আর ভোটে লড়বেন না।’’
এ বার কি সেই লাভ পাবেন অশোকবাবু!
পরিবর্তনের ২০১১ সালের পর ফের জোর লড়াইয়ের মুখে অশোক। ওই বছর শুধু হেরেছিলেন তিনি। সেখানে শঙ্কর তিরিশ বছর বাম দল করে শেষে দমবন্ধ পরিবেশের কথা শুনিয়ে হাতে চে গেভারা’র ট্যাটু নিয়েই গেরুয়া দলের প্রার্থী হয়েছেন। যা নিয়ে দলের অন্দরে ক্ষোভ থাকলে তা মিটেছে, বলছেন অনেকে। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে শঙ্কর বলেছেন, ‘‘শহরের সঠিক উন্নয়নের কাজগুলোই হয়নি। ডবল ইঞ্জিনের সরকার দিয়ে কাজগুলি করতে হবে।’’
এই আলোচনার মাঝে শহরের ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে মিশ্র জনজাতির শিলিগুড়ি বিধানসভার হিসেব খানিকটা এদিক-ওদিক করতে কলকাতা থেকে হাজির তৃণমূলের প্রার্থী ওমপ্রকাশ মিশ্র। শঙ্কর স্কুলশিক্ষক, ওমপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের। খোলা চোখে ত্রিমুখী লড়াইয়ের কথা মনে হলেও আদৌও কি তাই! ওমপ্রকাশ প্রার্থী হতেই শাসক দলে ক্ষোভের বন্যা শুরু হয়। নান্টু পাল নির্দল হয়ে শেষে বিজেপিতে। দীপক শীল, জ্যোৎস্না আগরওয়ালারা এই বাজারে সুযোগ বুঝে গেরুয়া দলে। দলের সভাপতিও রঞ্জন সরকারও প্রথমে ক্ষোভে ফুঁসে শেষে কলকাতার নেতাদের কোনও ‘আশ্বাসে’ রাস্তায় নেমেছেন। গৌতম দেব নিজের ভোট নিয়ে ব্যস্ত।
দলের জেলার নেতারাই বলছেন, গুছিয়ে কিছুই যেন হচ্ছে না। প্রতিবার প্রার্থীর হয়ে ঠিকঠাক ভোট না করানোর অভিযোগ নিয়ে এ বারও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, নজরদারি। মিছিল মিটিঙের ফাঁকেও কেউ কেউ বলছেন, পুরো প্রচারের কাজ হচ্ছে না। প্রার্থী অনেক সময় নিজের মতো চলছেন।
অশোক বলেছেন, ‘‘নানা দলের লোকজনও অনেকেই ফোন করছেন। নানা কথাই হচ্ছে। শিলিগুড়ির মানুষ পাশে আছেন। আমরাই জিতব।’’ আর ওমপ্রকাশ সেখানে নিজের গায়ের বহিরাগত তকমা ঝেড়ে বলছেন, ‘‘আমি এখানে পড়েছি। ডুয়ার্সের ছেলে। শিলিগুড়িতে পরিবর্তন হবেই।’