প্রতীকী ছবি।
লাল মেঠো পথ। পথের ধুলোয় রঙিন মাটির বাড়ির দেওয়ালও। গনগনে রোদ মাথায় নিয়েই বাড়ির উঠোনে বসে ধামসা, মাদলে তাল ঠুকছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুরেন হাঁসদা ও পড়শি মন্টু বেসরা। এখন তো কোনও উৎসব নেই, তার পরেও ভরদুপুরে মহড়া কেন? সুরেন বলেন, ‘‘উৎসব আছে তো! ভোট উৎসব। সভা, মিছিল রঙিন করতে ধামসা, মাদল নিয়ে সব দলেরই কর্মসূচিতে ডাক আসছে। ফলে আমাদেরও কিছু রোজগার হচ্ছে।’’ আপনাদের ভোট এ বারে কোন দিকে? ধামসা, মাদলে তাল দিয়ে মুচকি হাসেন সুরেন, মন্টু।
তাঁদের মুচকি হাসির কারণও আছে বলে জানান ডান-বাম সব শিবিরই। আদিবাসী প্রধান হবিবপুর ও গাজল বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটের নিয়ন্ত্রক সুরেন, মন্টুরাই। পরিসংখ্যান বলছে, হবিবপুরে প্রায় ৩৯ শতাংশ এবং গাজল বিধানসভায় ২১ শতাংশ আদিবাসী ভোট। এই দুই কেন্দ্র এক সময় জেলার রাজনীতিতে লাল দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। রাজ্যে পালাবদলের হাওয়াতেও অটুট ছিল দুর্গ। এমনকি, ২০১৬ তেও হবিবপুর ও গাজল ধরে রেখেছিল বামেরা। গাজলে ব্যাপক ভোটে জয়ী হলেও ২০১৬ সালে লাল দুর্গের ভিত আলগা হয়েছিল হবিবপুরে। মাত্র আড়াই হাজার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী খগেন মুর্মু। আর দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসে তৃণমূল। তার পরে টাঙন, পুনর্ভবা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে যায়। বিধায়ক সংখ্যা শূন্য হয় বামেদের। গাজলের বিধায়ক দীপালি বিশ্বাস সিপিএম থেকে তৃণমূলের ঘর ঘুরে এখন পদ্ম শিবিরে। যদিও এবারে তাঁকে প্রার্থী করেনি তাঁর নয়া দল। পদ্ম শিবিরে গিয়ে উত্তর মালদহের সাংসদ হয়ে দলের অন্যতম প্রধান মুখ খগেন।
বিধায়কদের রং বদলের সঙ্গে সঙ্গে হবিবপুর ও গাজলের লাল রংও যেন ফিকে হয়ে এখন গেরুয়া। খগেনের দলবদলের পরে হবিবপুরের উপনির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথমে উঠে আসে বিজেপি। তৃতীয়ে চলে যায় বামেরা। আর লোকসভা ভোটে হবিবপুর ও গাজলের উপরে ভর করেই উত্তর মালদহের দখল নেয় বিজেপি। সেখানে ধরাশায়ী হয় বামেরা। পঞ্চায়েত ভোটেও হবিবপুর, গাজলে সাফল্য পেয়েছে বিজেপি। বিরোধীদের দাবি, হাওয়ায় হবিবপুর, গাজলে সাফল্য এসেছে বিজেপির। যদিও বিরোধীদের সেই দাবি মানতে নারাজ গেরুয়া শিবির। গেরুয়া শিবিরের কান পাতলেই শোনা যায় আদিবাসী মহল্লায় বীজ বোনার কাজ শুরু হয়েছিল এক দশক আগেই। হবিবপুরের ভালুকবোনায় চলছে সঙ্ঘ পরিবারের একল বিদ্যালয়ের প্রকল্প। আদিবাসীদের একাংশ খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি ঝুঁকেছেন। তাঁদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ বারে গাজলের বাসিন্দা গুরুমা নামে পরিচিত কমলি সোরেন পেয়েছেন কেন্দ্রের ‘পদ্ম’ সম্মানও। বিজেপি এর সুফল পাচ্ছে বলে দাবি গেরুয়া শিবিরের নেতাদের।
যদিও ধর্মান্তরকরণ নিয়ে চোরাস্রোত বয়ছে আদিবাসী মহল্লায়। আদিবাসী সংগঠনের নেতা মোহন হাঁসদা বলেন, “আদিবাসীদের ধর্ম কখনও হিন্দু নয়। আমাদের সারনা ধর্ম। যা নিয়ে আদিবাসীরা আন্দোলনও করছেন। অথচ, কমলি সোরেনকে পদ্ম সম্মান দেওয়া কেন্দ্র সরকার আমাদের দাবিকে আমলই দিচ্ছে না।”
আদিবাসী ভোটের মতো ফ্যাক্টর রাজবংশী, মতুয়া ভোটও। তাই গাজলে অঙ্ক কষে স্কুল শিক্ষিকা বাসন্তী বর্মণকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। বিজেপির প্রার্থী বাসন্তীর সম্প্রদায়েরই যুবক চিন্ময় দেব বর্মণ। ভোট কাটাকাটির খেলায় কতটা ফায়দা তুলতে পারবেন সিপিএম প্রার্থী অরুণ বিশ্বাস, তা নিয়েই চর্চা গাজলে। হবিবপুরে বিজেপি আস্থা রেখেছে বিদায়ী বিধায়ক জোয়েল মুর্মুর উপরেই। আর তৃণমূলের ভরসা বিজেপির ঘর থেকে আসা প্রদীপ বাস্কে। তাঁর গ্রামেরই বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ঠাকুর টুডুকে প্রার্থী করেছে সিপিএম।
রাজনৈতিক ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি জনজাতি প্রধান দুই বিধানসভার মিল রয়েছে সমস্যাতেও। জমিতে সেচের সমস্যা থেকে শুরু করে পানীয় জল, রাস্তা, পথবাতির সমস্যা রয়েছে। গাজলে পুরসভা, দমকল কেন্দ্র গড়া নিয়েও একগুচ্ছ দাবি রয়েছে। দাবি রয়েছে হবিবপুর ব্লকে কলেজেরও। যদিও ভোট প্রচারে দাবি, উন্নয়নের ইস্যুকে ছাপিয়ে ধর্মের অস্ত্রেই শান দিচ্ছেন যুযুধান সব পক্ষ। ফলে লালমাটিতে এখন লড়াই দুই ফুলেরই।