—প্রতীকী ছবি।
শংসাপত্র, চাকরির কোটা― সবেতেই উল্লেখ করা রয়েছে যে তিনি প্রতিবন্ধী। তবু পিছু ছাড়ে না জেলা নির্বাচন দফতর। প্রতি বার চিঠি আসে ভোটের দায়িত্বে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার। আর সেই নাম কাটাতে দূর-দূরান্ত থেকে জেলাশাসকের দফতরের নির্বাচনী অফিসে যেতে হয় অসুস্থ শরীর নিয়ে। সেখান থেকেই আরও এক দিন মেডিক্যাল করতে পাঠানো হয় সরকারি হাসপাতালে। যা দেখে তিতিবিরক্ত চিকিৎসকেরাও। কেন ফি বার সরকারি কাজে গাফিলতির বোঝা টানবেন তাঁরা? জানতে চাইছেন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লড়াই করে চলা মানুষেরা।
২০১৪ সালে জেলা নির্বাচন অফিসকে দেওয়া নির্দেশিকার ২৯ নম্বর পৃষ্ঠার ৪.৫ পয়েন্টে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট বলছে যে, প্রতিবন্ধী সরকারি কর্মীকে নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে ছাড় দিতে হবে। তা সত্ত্বেও প্রতি বছর এমন অসংখ্য কর্মীকে হেনস্থা হতে হয় বলে মেনে নিচ্ছেন জেলা নির্বাচন অফিসের আধিকারিকেরা। তাঁদের দাবি, এ জন্য মূল দায় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির। গোড়ায় গলদের সংশোধন না হলে এমনটা চলতেই থাকবে।
প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের পদে প্রতিবন্ধী কোটায় ২০১৭ সালে চাকরি পেয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত কোটালবের গ্রামের বিক্রম মল্লিক। তার পরে ২০১৮, ২০১৯ এবং ফের ২০২১ সালেও ভোটের ডিউটি থেকে নাম কাটাতে যেতে হয়েছে তাঁকে। এর জন্য ৫০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তাঁকে আসতে হয় বারাসতে জেলাশাসকের দফতরে। তেতলার ট্রেনিং প্রোগ্রামের ঘরে ভোটের চিঠি নিয়ে গেলে তাঁকে পাঠানো হয় মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে। এ জন্য ফের তাঁকে পরদিন ততটাই পথ পেরিয়ে যেতে হয় বারাসত জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে সরাসরি জেলা নির্বাচন অফিসে পৌঁছে যায় চিকিৎসকের মতামত।
বিক্রমের মতোই ঘুরতে হয় প্রতিবন্ধী শংসাপত্র হাতে থাকা অসংখ্য সরকারি কর্মীকে। যেমন, হাবড়ার অনির্বাণ নিয়োগী। প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক অনির্বাণের ডান পায়ের সমস্যা তাঁকে ৪৫ শতাংশ প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র দিয়েছে। তাঁকেও প্রতি বার ভোটের ডিউটির চিঠি পেয়ে নাম কাটাতে হয়। এ বারেও সেই ‘নিয়মের’ ব্যতিক্রম হয়নি।
তাই ওই সব মানুষেরা প্রশ্ন তুলছেন, প্রতি বার নির্বাচন এলেই কেন তাঁদের প্রতিবন্ধকতা প্রমাণ করতে যেতে হবে? একই প্রশ্ন তুলেছেন বারাসত জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসক। তাঁর বক্তব্য, এমনিতেই সরকারি হাসপাতালে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। তার মধ্যে প্রতিবন্ধী শংসাপত্র থাকা সত্ত্বেও অহেতুক সেই ভিড় বাড়িয়ে ওঁদের পক্ষে পরিস্থিতি আরও জটিল করা হচ্ছে। কেন সরকার এর স্থায়ী সমাধান করবে না?
৬০ শতাংশ স্থায়ী প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র সেই ২০০৯ সাল থেকেই রয়েছে বিক্রমের সঙ্গে। সে বার ডান হাতের হাড়ে ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। মুম্বইয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করে রেডিয়াস বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেই জায়গায় চিকিৎসকেরা আলনা কেটে লাগিয়ে দেন। আর আলনার জায়গায় স্টিলের প্লেট বসানো হয়। বছর তেত্রিশের যুবক চাকরিও পেয়েছেন প্রতিবন্ধী কোটায়। বিক্রম বলছেন, “ট্রেনে বা যে কোনও ভিড়ে যাতায়াত করতে ডাক্তারবাবুরা নিষেধ করেছেন। তাই দু’দিন যেতে-আসতে ৮০০ টাকা করে মোট ১৬০০ টাকায় টোটো ভাড়া করতে হয়েছিল। স্কুলে ছুটি নিয়েছিলাম।”
সংশ্লিষ্ট জেলার এক নির্বাচনী আধিকারিক জানাচ্ছেন, শুধু এই জেলায় নয়, প্রতি বছর সর্বত্র একই সমস্যা হয়। যার মূল দায় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির। যেখান থেকে কর্মীদের নাম পাঠানো হচ্ছে, সেই দফতরকে বিস্তারিত তথ্য লেখার ক্ষেত্রে আরও যত্নবান হতে হবে। নামের তালিকার সঙ্গে যে মন্তব্য লেখার জায়গা থাকে, সেখানেই স্পষ্ট করে ব্যক্তির ‘স্টেটাস’ দেওয়া থাকলে নির্বাচন অফিসে জমা পড়া লক্ষাধিক নামের তালিকা দেখে বাছাইয়ে সুবিধা হয়। যদিও উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত বলছেন, “এখন খুবই ব্যস্ত। কোথায় গাফিলতি হয়েছে বলা সম্ভব নয়।”
ফলে এর পরেও যে এই গাফিলতি শোধরানোর কোনও চেষ্টাই হবে না, তা নিয়ে এক প্রকার নিশ্চিত অনির্বাণ-বিক্রমেরা।