শোকাতুর মোসারেকের স্ত্রী আশানুর বিবি। নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের অফিসে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত দু’জনের শনিবার রাতে মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। সোমবার সকালে বাঁকুড়ার জয়পুরের বনপদুয়ার সেই ইয়াজুল মোল্লা (৩০) ও মুরলিগঞ্জের মোসারেক আলি খাঁর (৬০) পরিজনেরা দাবি করেন, খবর আসার পরে ব্লক তৃণমূলের কেউ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। মোসারেকের ছেলে জব্বার আলি খাঁর ক্ষোভ, “যে দলে বাবা এত দিন কাটাল, তাঁদের কারও দেখা মেলেনি। অথচ, সিপিএমের মিছিলে গিয়ে চোরকলার মইদুল মিদ্যা মারা যাওয়ার পরে স্ত্রীকে তড়িঘড়ি চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করল সরকার আর তৃণমূল নেতারা।’’ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে জয়পুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি ইয়ামিন শেখ বলেন, ‘‘ওই দু’জনের বাড়িতে গিয়ে পরিজনেদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় অঞ্চল সভাপতি দিলীপ ঘোষ। আমরাও ব্লক কমিটি থেকে যাচ্ছি।’’
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার দুপুরে জয়পুরের মুরলীগঞ্জে তৃণমূলের অফিসে বোমা ফেটে পাঁচ জন আহত হন। তাঁদের প্রথমে আরামবাগ হাসপাতাল, পরে কলকাতার এনআরএস মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হয়। শনিবার রাতে সেখানেই মৃত্যু হয় ইয়াজুল ও মোসারেকের। ছেলে জব্বারের দাবি, ১৯৯৮ সাল থেকেই মোসারেক তৃণমূলের সঙ্গে ছিলেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, মাঝে কয়েকবছর তাঁকে সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করতে দেখা যায়নি। বছর দু’য়েক ধরে আবার দেখা যাচ্ছিল।
জব্বার বলেন, “ঘটনার দিন আমি বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর পাই, বাবার দুর্ঘটনা হয়েছে। গিয়ে দেখি, সারা শরীর জ্বলে গেছে। পরে জানতে পারি, তৃণমূল অফিসে বিস্ফোরণ ঘটেছে।’’ মোসারেকের দুই ছেলের মধ্যে ছোট জব্বর। তিনি এলাকার সাইবার ক্যাফেতে কাজ করেন। দাদা কাজের সন্ধানে রয়েছেন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। দিদির মানসিক সমস্যা রয়েছে। তিনি বাড়িতেই থাকেন। কোনও জমিজমাও নেই পরিবারটির। নিহতের স্ত্রী আশানুর বিবি বলেন, ‘‘একটা চাকরি বা অন্য সাহায্য না পেলে পুরো পরিবারটাই ভেসে যাবে!’’
বনপদুয়ার হত ইয়াজুল মোল্লার এক সময়ে ভিন্ রাজ্যে জরির কাজ করে সংসার চালাতেন। বছর দু’য়েক আগে বাড়ি ফিরে এসে সেই কাজ করছিলেন। আট মাস আগে পরিবারের লোকজন তাঁকে সক্রিয় ভাবে তৃণমূলের কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখেন। তাঁরা জানান, কিছু দিন হল একশো দিনের কাজের সুপারভাইজার হিসাবে কাজ করছিলেন ইয়াজুল। বাবা ও দাদা কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। বাড়িতে ছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে। ইয়াজুলের রোজগারেই সংসার চলত। তাঁর স্ত্রী হুসেনা খাতুন বলেন, ‘‘শুক্রবার ছোট্ট বাচ্চাটাকে স্বামীর কোলে দিয়ে বাড়ির কাজ করছি। আচমকা একটা ফোন আসতেই বাচ্চাকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।’’ কয়েক ঘণ্টা পরে, বিস্ফোরণের খবর পান হুসেনা। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘রবিবার ভোরে জানতে পারলাম, স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূল করতে গিয়েই এমনটা হল। কিন্তু এখনও দলের কেউ বাড়ি আসা তো দূরে থাক, ফোনেও যোগাযোগ করেনি।” ইয়াজুলের মা জুলেখা মোল্লা বলেন, ‘‘এত বড় সংসারের খরচ আর চিকিৎসার টাকা কোথা থেকে আসবে জানি না!’’
বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি শ্যামল সাঁতরা বলেন, ‘‘পরিবারগুলির পাশেই আমরা আছি। দলীয় ভাবে সব কিছুর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অঞ্চল নেতৃত্ব গিয়েছিলেন। ব্লকের নেতারও যাচ্ছেন।’’ জয়পুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি ইয়ামিন শেখের অভিযোগ, ‘‘জায়গা ফিরে পেতে বোমা আর পিস্তল নিয়ে গোলমাল পাকাচ্ছে সিপিএম।’’ অন্য দিকে, ভোটের আগে এলাকা অশান্ত করতে তৃণমূল হিংসার রাজনীতি করছে বলেই অভিযোগ সিপিএমের জয়পুর দক্ষিণ এরিয়া কমিটির সম্পাদক মানিক রায়ের। তাঁর দাবি, ‘‘বোমা বাঁধতে গিয়ে তৃণমূলের অফিসে এই ঘটনা ঘটেছে। এলাকায় সন্ত্রাস চালাতে সেখানে বোমা ও কয়েক কুইন্টাল বারুদ মজুদ করেছিল ওরা। পুলিশ মাত্র চারটি বোম উদ্ধার করেই ছেড়ে দিল। নির্বাচনের আগে কী ভাবে আতঙ্ক কাটবে সাধারণ মানুষের?’’ পুলিশের অবশ্য দাবি, ঠিক পথেই তদন্ত এগোচ্ছে।