—প্রতীকী ছবি।
‘আচ্ছা আপনাদের রাজ্যে কি করোনার প্রকোপ কমে গিয়েছে?’
ব্রিগেডের ভিড় দেখে কলকাতার এক বাসিন্দাকে প্রশ্নটা করেছিলেন পরিচিত এক কেরলবাসী। উচ্ছ্বসিত কলকাতাবাসীর উত্তর ছিল, ‘‘কমেছে বলেই তো মনে হচ্ছে। করোনায় তো তেমন কেউ মারা যাচ্ছেন না।’’ আমজনতার এই ‘ভুল’ ধারণাতেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের অশনি সংকেত চাপা পড়েছে বলে আক্ষেপ চিকিৎসকদের একাংশের। তাঁরা বলছেন, ‘‘ভোট আসতেই করোনাকে প্রায় সকলেই ভুলতে বসেছেন। মাস্ক না পরে, দূরত্ববিধি শিকেয় তুলে সভা, মিছিল হচ্ছে। এই গা ছাড়া মনোভাবই করোনার নতুন দাপটের সুযোগ করে দিচ্ছে।’’
চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, যে কোনও অতিমারির গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী একটা সময়ের পরে সংক্রমিতের সংখ্যা কম হয়। মৃত্যুও কম হয়। গত ১ মার্চ রাজ্যে করোনায় একজনও মারা যাননি। কিন্তু ওই দিনই কলকাতায় ৬২ জন, উত্তর ২৪ পরগণায় ৪৮ জন এবং হাওড়াতে ৩১ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু নেই মানে করোনা নেই, এই ধারণাটাই ভুল।’’ এমনকি, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগীরাজ রায় জানাচ্ছেন, করোনার প্রথম পর্বে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্রের থেকে পশ্চিমবঙ্গ সাধারণত এক মাস পিছিয়ে ছিল। বর্তমানে মহারাষ্ট্রের যা পরিস্থিতি, তা রাজ্যে ঠিক ভোট শুরুর পর্বে দেখা যেতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘দ্বিতীয় ঢেউ আসবেই। কিন্তু যত ক্ষণ মৃত্যু না হয় তত ক্ষণ টনক নড়ে না। এমন যেন না হয় কোভিডের জন্য বুথে এজেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না।’’
ওই চিকিৎসকেরা এ-ও জানাচ্ছেন, আমজনতার মধ্যে আরও একটি ভ্রান্ত ধারণা হয়েছে যে প্রতিষেধক দেওয়া চালু হয়েছে, তাই করোনা বাড়বে না। কিন্তু রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৫ মার্চ রাত পর্যন্ত প্রতিষেধক পেয়েছেন মাত্র ২৫ লক্ষ ৯২ হাজার জন। যা মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশের কাছাকাছি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বলেন, ‘‘অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া না হলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে না। কোথাও তো নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে না যে প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কোভিডে আক্রান্ত হবেন না। তবে এটা ঠিক যে সে ক্ষেত্রে করোনা হলেও, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা হয়তো গুরুতর হবে না। কিন্তু ওই ব্যক্তির থেকে সংক্রমণ ছড়াবে।’’
শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলছেন, ‘‘ভাইরাস রক্তে মেশার পরে প্রতিষেধক কাজ করবে। কিন্তু করোনা ভাইরাস প্রথমে নাকে ও গলায় থাকে। তা হলে প্রতিষেধক নেওয়া মানুষও সহজেই ভাইরাসটি অন্যকে ছড়াতে পারেন।’’
শহর থেকে জেলা— বিধানসভা ভোটের আবহে করোনা বিধি, কার্যত সকলেই ভুলে যেতে বসেছেন। ‘মাস্ক কেন পরেননি?’ প্রশ্ন করলেই অনেকে উত্তর দিচ্ছেন, ‘বেশিক্ষণ পরে থাকলে কষ্ট হচ্ছে।’
অনির্বাণ বলছেন, ‘‘মাস্ক পরে থাকলে সাময়িক কষ্ট হতে পারে কিন্তু তাতে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে মৃত্যু হবে না বা অন্য কোনো স্থায়ী সমস্যা হবে না।’’ শ্বাসকষ্টের রোগী ছাড়া অন্য কারও মাস্ক পরে থাকলে কষ্ট হওয়ার কারণ নেই বলে জানাচ্ছেন বক্ষরোগ চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘মাস্ক পরে থাকলে শ্বাস নেওয়া-ছাড়া কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয় ঠিকই। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। পুরোটাই অভ্যাসের বিষয়। সকলকে এন-৯৫ মাস্ক পরতে হবে, তা নয়। তবে ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল বা কাপড়ের মাস্ক পরতে হবে।’’
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত মোর্চার ব্রিগেড ছিল। তার ১০-১২ দিন পরের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যাটা ২০০ টপকে গিয়েছে। আবার ৭ মার্চ ছিল বিজেপির ব্রিগেড। তার পরে এখনও ১০-১২ দিনের সীমারেখা পার হয়নি। কিন্তু ইতিমধ্যেই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০০-র কাছাকাছি। চিকিৎসকেরা বলছেন, এক জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সংখ্যাটা দ্বিগুণ হতে হতে এগিয়ে চলে। যেমন এক থেকে দুই, তার থেকে চার, তার থেকে আট, তার থেকে ১৬।