সঙ্গী: ভোট দিয়ে ফিরছেন সন্ধ্যামণি মণ্ডল ও হিমাদ্রিশেখর মণ্ডল। শনিবার, যাদবপুরে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
লকডাউন দেখিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই অসহায় এ শহরের বয়স্কেরা। সেই সময়ে বয়স্কদের সঙ্গে হওয়া অপরাধ যেমন বেড়েছিল, তেমনই বেড়েছিল নানা জায়গা থেকে আসা একা থাকা বয়স্কদের মৃত্যুর খবর। জরুরি পরিস্থিতিতে ডেকেও বহু ক্ষেত্রেই চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ ছিল। সংক্রমণের ভয়ে সাহায্যে এগিয়ে যেতেও দ্বিধায় ভুগেছেন প্রতিবেশীরা। বিদেশে কর্মরত বহু ছেলে-মেয়েরই দাবি, বয়স্ক বাবা-মায়ের দেখভালে ঠিক করে যাওয়া সংস্থাকে বার বার ফোন করেও সাড়া পাননি!
সেই সব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোট ঘিরে ফের করোনা সংক্রমণের বৃদ্ধি। এই দুইয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন বহু বয়স্ক ও দূরে থাকা তাঁদের আত্মীয়েরা। ভোটবঙ্গে এই মুহূর্তে তাঁদের এই আতঙ্ক নিয়ে কোনও পক্ষই মাথা ঘামাতে রাজি নয়, বলে তাঁদের দাবি। শনিবার চতুর্থ দফায় প্রথম ভোট ছিল কলকাতার বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে। দিনভর বুথে বুথে ঘুরে বয়স্কদের সেই আতঙ্কই যেন নজরে পড়েছে।
দেখা হয়েছিল যাদবপুরের বৃজি এলাকায় একটি বুথ থেকে ভোট দিয়ে বেরোনো প্রবীণ দম্পতির সঙ্গে। বছর তিরাশির স্বামী হিমাদ্রিশেখর মণ্ডলের হাত ধরে ধীরে হাঁটছিলেন আটাত্তর বছরের সন্ধ্যামণি। লাল পেড়ে সাদা শাড়িকে যেন টেনে নিয়েই চলছেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ। কয়েক পা এগোতেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যাদবপুরের বিজেপি-প্রার্থীর। সদ্য সিপিএম ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া সেই প্রার্থীকে দেখেই হাত মুঠো করে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘তোরা যা-ই করিস। আমাদের মতো পুরনোদের মনটা কিন্তু একই রয়েছে।’’ উল্টো হাওয়া বুঝে দুই বয়স্ককে করোনা পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দ্রুত বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রার্থী। বৃদ্ধা বলেন, ‘‘করোনার কথা মনে রেখেই তো ভোট দিলাম। যাতে ভোটের জ্বালায় ফের লকডাউন হলে, আগের বারের অবস্থা না হয়।’’
ডবল এমএ পাশ, এলাকার দিদিমণি সন্ধ্যামণিদেবী বলে চলেন, ‘‘বৃজির যে স্কুলে ভোট দিলাম, সেখানেই পড়াতাম। ৭৭-এ যখন স্বামীর সঙ্গে এ তল্লাটে এলাম, স্বাক্ষরতার হার প্রায় শূন্য। স্কুলটা নিজেরাই করেছিলাম। ওখান থেকেই ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আছড়ে ফেলা হয়েছিল। কারণ এক দল লোক স্কুলের জমিটার দখল নিতে চাইছিল। সেই থেকেই লড়াই চলছে।’’ স্বামীকে দেখিয়ে বৃদ্ধার মন্তব্য, ‘‘ওই স্কুলেই রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। সে কালে ভালবেসে বিয়ে আমাদের। পরিবার প্রথমে মানেনি। দুই ছেলের এক জন আমেরিকায়, অন্য জন বেঙ্গালুরুতে। তারা ভোট দিতে আসেনি। লকডাউনেও তারা আসতে পারেনি। করোনার জন্য বাড়িতে থাকতেই বলেছিল। বলে দিয়েছি, লড়াইটা যখন আমাদের, আমরাই ঠিক করব ভোট দেব কি না!’’
একই রকম প্রত্যয়ী কসবার সুইন হো লেনের বাসিন্দা বছর চুয়াত্তরের শচিনকুমার বর্মণ। ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি আর আমার দাদা, নন্দকুমার বর্মণ এক বাড়িতেই থাকি। কেউই বিয়ে করিনি। লকডাউনের মধ্যে সামান্য ওষুধ এনে দেওয়ার কেউ ছিলেন না। কসবা থানায় বার বার ফোন করা হলে বলা হয়েছে, ওই থানাতেই তিরিশের উপরে কর্মী আক্রান্ত।’’ বেহালা পূর্বের বাসিন্দা সীমা ঘোষ আবার ভোট দিতে এসেছিলেন ছেলে রতনের সঙ্গে। সীমাদেবী জানান, ভোট উপলক্ষেই মায়ের বাড়িতে এসেছিলেন পরিবার নিয়ে উল্টোডাঙায় উঠে যাওয়া রতন। ছেলের সামনেই সত্তর বছরের বৃদ্ধার মন্তব্য, ‘‘বৌমা আর আমার বনে না। লকডাউনে ছেলেকে পাইনি। সেই ছেলেই আজ ভোট দিতে আসার সময়ে মাস্ক পরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।’’ যা শুনে রতনবাবু হেসে বললেন, ‘‘আগে পারিনি বলে এখনও মায়ের খেয়াল রাখব না? মাকে বলেছি, ভোটটা ভেবে দিও।’’
প্রায় নুইয়ে পড়া বছর চুরাশির স্নেহবালা ঘোষ টালিগঞ্জের বুথ থেকে বেরিয়েই বলে ওঠেন, ‘‘আমার জন্য কিন্তু ছেলে অনেক করেছে। আমার যা হওয়ার হবে, লকডাউন হলে ওর চাকরিটা আর থাকবে না। সেই ভেবেই ভোটটা দিলাম। আর তাই সারাক্ষণ মাস্কও পরেছিলাম।’’