ফাইল চিত্র।
শান্ত, সংযত শপথ অনুষ্ঠান। অথচ তার মধ্যে থেকে গেল খোঁচাও। সাধারণত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে এমনটা হয় না। কিন্তু বুধবার তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান কিছুটা ব্যতিক্রমী হয়ে উঠল।
দশ বছর আগে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা শপথ নিয়েছিলেন রাজভবনের লনে। দ্বিতীয় বার অনুষ্ঠান হয়েছিল রেড রোডে। এ বারই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতা শপথ নিলেন চার দেওয়ালের মধ্যে, রাজভবনের থ্রোন রুমে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে হাতে-গোনা কিছু অতিথির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান ছিল সংক্ষিপ্ত। সেই অনুষ্ঠানের পরেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তার জবাব দেন মুখ্যমন্ত্রীও। নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক দায়িত্ব যখন মুখ্যমন্ত্রীর উপরে ছিলই না, সেই সময়ের ঘটনার প্রসঙ্গে রাজ্যপাল কেন মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলছেন, বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেই প্রশ্নেই। বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলার পরেও রাজ্যপাল কেন ওই কথা বলতে গেলেন, তার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই।
প্রথা এবং নির্ঘণ্ট মেনে এ দিন সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে শপথবাক্য পাঠ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে সাংবিধানিক কিছু আচার সম্পন্ন করে মুখ্যমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করা। সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করব, শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি বজায় রাখুন। বাংলা অশান্তি পছন্দ করে না। আমি নিজেও করি না। প্রত্যেককে বলব, কোথাও যাতে কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি আজ থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করব কঠোর হাতে। এটা আমার দ্বিতীয় কাজ। নবান্নে ফিরে গিয়ে যেখানে যেখানে যাদের পোস্টিং করতে হবে, সেখানে সেখানে তা করব। কোনও অশান্তি হলে কঠোর পদক্ষেপ করব।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘এখন খুব সঙ্কটের সময়। ভোট-পরবর্তী ভয়ানক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের প্রথম কর্তব্য, সেই উন্মত্ত হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রচুর মানুষকে তা প্রভাবিত করছে। ভোট-পরবর্তী এমন হিংসা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়। আশা করব, জরুরি ভিত্তিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে মুখ্যমন্ত্রী সব ধরনের পদক্ষেপ করবেন। বিশেষ করে, শিশু এবং মহিলাদের মধ্যে যাঁরা এই হিংসায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের সুরাহার ব্যবস্থা করা দরকার। নতুন সরকারের কাছে আমি সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিবেশ আশা করি। আশা করব, সংবিধান মেনে সরকার চলবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী রাজভবন ছাড়ার পরেই এ দিন ফের টুইট করে রাজ্যপাল বলেছেন, ভোট-পরবর্তী হিংসার ঘটনায় তিনি উদ্বিগ্ন। আইনশৃঙ্খলার এ ভাবে ভেঙে পড়া এড়িয়ে যাওয়া চলবে না।
রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, বিতর্কের বীজ রোপিত হয় রাজ্যপালের বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী যখন নিজে থেকেই কঠোর হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছিলেন, তখন রাজ্যপালের পাল্টা মন্তব্যে মমতার উদ্দেশে নিছকই খোঁচা ছিল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। তাঁদের ধারণা, সম্ভবত এই কারণেই প্রত্যুত্তর দিতে ছাড়েননি মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপালের বক্তব্যের পরে ফের মাইক হাতে নিয়ে মমতা বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দল যেখানে যেখানে জিতেছে, সেখানে সেখানে অত্যাচার করছে। এদের কেউ যেন রেহাই না পায়, তা আমরা দেখে নেব। এই তিন মাসের ব্যবস্থা আমার হাতে ছিল না। ফলে, সেখানে অনেক দুর্বলতা এবং অক্ষমতা থাকতে পারে। আজকেই গিয়ে আমি নতুন সেট-আপ তৈরি করব। আবেদন করব, কেউ যেন কারও প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ না হন।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, মমতার পরের বক্তব্যের দু’টি দিক রয়েছে। এক, ভোটের আগে থেকে এবং ভোটের সময় বিজেপির যে আচরণ ছিল, তা স্বাভাবিক পরিস্থিতির পক্ষে অনুকূল নয়। ভোট-পরবর্তী হিংসার পিছনে বিজেপি যে দায় এড়াতে পারে না, তা-ই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই, নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে একে একে রাজ্য পুলিশের ডিজি, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)-সহ একাধিক জেলার পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসককে বদলি করে নির্বাচন কমিশন। হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজ্যের সঙ্গে পরামর্শ না করে অফিসার বদলি করেছিল কমিশন। রাজ্যের কোনও আপত্তি এ ক্ষেত্রে ধর্তব্যের মধ্যেও আনেননি কমিশনের কর্তারা। নির্বাচনী প্রচারেও এ নিয়ে একাধিক বার সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই কারণেই এ দিন মমতা কার্যত আক্ষেপ করেছেন, গত তিন মাস আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কোনও উপায়ই তাঁর হাতে ছিল না। শপথের পরে নবান্নে গিয়েই পুলিশ-প্রশাসনে বেশ কিছু বদল এনে ফের নিজের ‘সেট আপ’ তৈরিরই ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
শপথের দিনেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শুভেচ্ছা-বার্তার উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইটে তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলার স্বার্থ মাথায় রেখে কেন্দ্রের ধারাবাহিক সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দিক থেকে পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। কোভিড-সহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জের একসঙ্গে মোকাবিলা এবং কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত আমরা যৌথ ভাবে তৈরি করতে পারি বলে আমার আশা।’’
ফল প্রকাশের পরবর্তী ‘সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে বিজেপি এ দিন শপথ অনুষ্ঠান বয়কট করেছিল। দাঁতের ব্যথায় কাবু বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু উপস্থিত থাকতে পারেননি। বিরোধী শিবিরের মধ্যে একমাত্র কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিলেন। বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় এ দিনই মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা-সহ চিঠি লিখে জানিয়েছেন, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ও দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিলগ্নীকরণের প্রতিবাদে মমতার যে কোনও উদ্যোগকে তাঁরা সমর্থন করতে প্রস্তুত। শুভেচ্ছা জানিয়েও আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক বিশ্বনাথ চৌধুরী চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সংযত থাকার বার্তা অগ্রাহ্য করে শাসক দলের যে কর্মী-সমর্থকেরা বিরোধীদের উপরে সন্ত্রাসে লিপ্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
রাজভবনের শপথগ্রহণ সেরেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সরাসরি চলে আসেন নবান্নে। স্বাভাবিক ভাবেই তৃতীয় বারের জন্য তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন প্রশাসনিক কর্তা-আধিকারিকেরা। নবান্নে পৌঁছতেই তাঁকে গার্ড অব অনার দেয় কলকাতা পুলিশ। তার পরেই শীর্ষ-কর্তাদের নিয়ে প্রশাসনিক কাজ শুরু করে দেন মুখ্যমন্ত্রী।