West Bengal Assembly Election 2021

Bengal election: টাকা ওড়ে সীমান্তের ভোটে, গরিব আঁধারেই

চার-চার বার পিছিয়ে নতুন ভিটে বানিয়ে কর্মকার পরিবার ভেবেছে, এ বার নিশ্চিন্দি। এত ভেতরে ঢুকে নদী আর বাড়িঘর তছনছ করবে না।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৬:০২
Share:

প্রতীকী ছবি।

ওইখানে, পদ্মার ওই সবজেটে নীল জলের মধ্যে কিছু কি নজরে পড়ল? আরও একটু উজিয়ে, নদীর মাঝখানে সেইখেনে যে চর জেগিছে, নল ঘাস জন্মিছে, সাদা বালির ওপরে— তার ঠিক আগে? পড়ল কিছু চোখে?

Advertisement

‘সবুজ সাথী’-র নতুন নীল লেডিজ় সাইকেলটাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে সামনের চাকার টাল ভাঙতে ভাঙতে উদাস হয়ে যান প্রবীণ সন্তোষ কর্মকার।

‘কিছুই দ্যাখলেন না, না?’

Advertisement

ঘাড় এ-দিক আর ও-দিকে নেড়ে সত্যি কথাটা বলার পরে, সন্তোষবাবুর কণ্ঠস্বর আরও গাঢ় হল। প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেন, “দ্যাখবেনটা কী করে, কিছুই যে আর নাই। আমরা দ্যাখেছি বলে চোখে লেইগে আছে। ওইখেনে আমাদের ভিটে ছিল, শেখালিপুর ইস্কুলে আরও কত ছেলের সঙ্গে পড়তাম। জমিদার বাড়ির আঁদাড়-বাদাড়ে দল বেঁধে খেলা হত। দুর্গা দালানে পুজো। সে কী বিশাল জমিদারি শ্রীকুমার রায়-সুকুমার রায়েদের, ২২ হাজার বিঘের এস্টেট! নদীর এক বাঁক ফেরতায় সব শেষ। গোটা খানদুয়া গ্রামটাকেই গিলে ফেলল পদ্মা। আর আমরা পিছোতে পিছোতে এই বয়রা গ্রামে।”

চার-চার বার পিছিয়ে নতুন ভিটে বানিয়ে কর্মকার পরিবার ভেবেছে, এ বার নিশ্চিন্দি। এত ভেতরে ঢুকে নদী আর বাড়িঘর তছনছ করবে না। চার বারই সে হিসেব ভুল প্রমাণ করেছে পদ্মা। এখন ‘নবাব রাস্তা’-র ধারে নর্দমার উপরে স্ল্যাব পেতে এক চিলতে দোকানে সাইকেল সারাই করেন গ্রামহারা, বাস্তুহারা সন্তোষবাবু। ছেলে স্বরূপ কম্পিউটার সারানোর পাশাপাশি কলকাতা থেকে যন্ত্রপাতি এনে ব্যবসার চেষ্টা করে। লকডাউনের মারে এই দোকানও বন্ধ ছিল, তখন রাজ্য সরকারের ‘ফ্রি রেশন’ না-থাকলে যে না-খেয়ে মরতে হত, মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন সন্তোষবাবু। জোড়াফুলের পতাকা উড়ছে তাঁর দোকানের বাইরে। শুধু আক্ষেপ, ‘সবুজ সাথী’র সাইকেলগুলো যদি আরও একটু ভাল মানের দেওয়া হত!

ভাঙনে ভিটেহারারা বিশেষ কিছুই ক্ষতিপুরণ পায়নি— আক্ষেপ স্বরূপের। ভাঙন রোধে সম্মিলিত উদ্যোগের কথাই বা কোন রাজনৈতিক দল বলছে? কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তী বলছেন, “ভাঙন মোকাবিলায় সার্বিক পরিকল্পনার দাবিতে আন্দোলন একমাত্র কংগ্রেস করে চলেছে। যেটুকু করা গিয়েছে, অধীর চৌধুরীর উদ্যোগে। এ বারেও কংগ্রেস ছাড়া আর কেউ ভাঙন নিয়ে একটি কথা বলছে?”

চলছে বিড়ি বাঁধার কাজ। মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। নিজস্ব চিত্র

পদ্মাপাড়ে খানদুয়া বেঁচে আছে শুধু বিএসএফ ক্যাম্পটির হোর্ডিংয়ে। উল্টো পাড়ে বাংলাদেশের গোদাগাড়ি, শিবগঞ্জ, কানসাট। দু’দেশের গোটা সীমান্ত রেখার মধ্যে গরু, মাদক, জাল নোট, সোনা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালানের ব্যস্ততম পথ এ’টি— বলে থাকেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এখন কী অবস্থা? গরু চালান পুরো বন্ধ, এক-রা সকলের। কোমরে দড়ি পড়েছে গরুর কারবারের ‘অন্যতম প্রধান মাথা’ এনামুল হক এবং তার নেটওয়র্কে যুক্ত কিছু পুলিশ ও বিএসএফ কর্তার। কিন্তু এনামুল যে ভোটের পরে ছাড়া পেয়ে ফিরবে না, এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না স্থানীয়রা। তবে অন্য পাচারের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে যান বয়রা বা লালগোলার মানুষ। লালগোলা, ভগবানগোলা, রঘুনাথগঞ্জ, সুতি, ফরাক্কা ও সন্নিহিত অঞ্চলের ভোটযুদ্ধে অনেক কিছুরই রাশ থাকে পাচারচক্রের হাতে। বেশ কিছু ফেরার জঙ্গিও ধরা পড়েছে এই সব এলাকা থেকে। নিমতিতায় জনবহুল স্টেশনে বোমা পেতে রাজ্যের মন্ত্রী জাকির হোসেনকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও সন্ত্রস্ত করেছে সাধারণ মানুষকে। তার পরেও বহু মানুষের পেট বাঁধা এই চালান-চক্রে, নেহাত একটা ঝুঁকির পেশা ছাড়া পাচারে অপরাধ দেখেন-না জড়িতদের অনেকেই। সেই কারণেই গরু পাচার বন্ধের ‘সাফল্য’ ভোটে প্রচার করছে না বিজেপি। বদলে ধর্মীয় মেরুকরণের বিপজ্জনক অস্ত্রে শান দিচ্ছে তারা।

আবার লালগোলা, জঙ্গিপুর, সুতি, রঘুনাথগঞ্জে রাজনীতির লাগামটা ধরে রাখেন বড় বড় বিড়ি ব্যবসায়ী। এঁদের কারখানায় অবশ্য বেঁধে আসা বিড়ি আঁচে রেখে ‘ফাইনাল টাচ’ দেওয়া এবং প্যাকেটে ভরার কাজটাই হয়। বিড়ি বাঁধা হয় বাড়ি বাড়ি। মহাজনের থেকে পাতা-তামাক-সুতো নিয়ে বিড়ি বাঁধেন মূলত মেয়েরা। সংসার সামলে, ছেলেপুলে দেখে, মুরগি-গরুর দেখভাল সেরে রোজ শ’পাঁচেক বিড়ি বাঁধতে পারেন লালগোলার রেজিনা খাতুন, আঙ্গুরা বিবি, নার্গিস খাতুনেরা। হাজার বিড়ি বেঁধে মেলে ১৩০ টাকা। সরকার ১৫০ টাকা দর বেঁধে দিলেও মহাজনেরা দেয় না। আবার বিড়ি শ্রমিকদের বাড়তি রেশন, ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করলে মাস-কাবারি ৫০০ টাকা করে দেওয়ার কথা সরকারের। শুনেছেন সকলেই, কিন্তু পান না। “ভোট আসে, টাকা ওড়ে— গরিবের এ সব সমস্যা নিয়ে উচ্চবাচ্যও কেউ করে না”, ক্ষোভ মানেদা খাতুনের।

তবে এই বিড়ি বাঁধার কাজ গরিব মেয়েদের যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে, তার প্রভাব চোখে পড়ার মতো— বলছিলেন লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের জাহাঙ্গির মিয়াঁ। এই অঞ্চলে বধূ নির্যাতন কম। স্বামী বেগড়বাঁই করলে মেয়েরা যা বলে থাকেন, তা কতকটা এই রকম— ‘হাতে আছে বিড়ির পাত/ খাবো না এই ভাতারের ভাত!’ এঁদের অনেকেরই বাড়ির পুরুষ আবার ভিন্ রাজ্যে মিস্ত্রি বা জোগাড়ের কাজ করেন। লকডাউনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের। জেলার তৃণমূল নেতা সারজামান শেখের ভরসা সেই সময়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা। “পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে দিদি যা করেছেন, তাঁরা ফেরার পরেও সরকার যে ভাবে পাশে থেকেছে, ভোটে তার ফল পাবই”, বলেন সারজামান। লোকসভা ভোটে এই দফার ১১টির মধ্যে ৭টি আসনে এগিয়ে ছিল তৃণমূল।

আবহমান কাল কংগ্রেসে আস্থা রাখা লালগোলা আসনে গত ছ’বার জয়ী আবু হেনা এ বারও প্রার্থী। তৃণমূলের মহম্মদ আলির সঙ্গে তাঁর টক্কর। আবার জেলায় নিজেদের অগোছাল অবস্থার কারণ হিসেবে ৬৭ শতাংশ মুসলিম ভোটকে দেখাচ্ছে বিজেপি। তবে ‘হিন্দু ভোট সংহত হলে’ ফলাফল বদলে যেতে পারে বলে আশা দলের নেতাদের। এ বার মুর্শিদাবাদ আসনটিকে পাখির চোখ করেছেন তাঁরা। গত লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ জেলার এই একটি আসনেই সামান্য ভোটে হলেও এগিয়ে ছিল পদ্মফুল। জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর ঘোষ সেখানে তৃণমূলের শাওনী সিংহ রায় এবং কংগ্রেসের নিয়াজুদ্দিন শেখের মুখোমুখি।

তবে প্রচারের শেষ লগ্নে বৈশাখের গরম, ভোটের গরমকে টেক্কা দিয়েছে করোনা সংক্রমণ। জেলায় কংগ্রেসের বটবৃক্ষ অধীর চৌধুরী সংক্রমিত হয়ে ঘরবন্দি। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বড়ঞায় কংগ্রেস প্রার্থী শিলাদিত্য হালদার, বেলডাঙার তৃণমূল প্রার্থী হাসানুজ্জামান। সংক্রমিত সব দলেরই বহু নেতা-কর্মীও। কোভিডে সংযুক্ত মোর্চার দুই প্রার্থীর মৃত্যুতে ২৬ এপ্রিলের ভোট পিছিয়ে গিয়েছে সমশেরগঞ্জ এবং জঙ্গিপুর কেন্দ্রে। ১৬ মে সেই ভোট দেওয়ার আগেই হয়তো ফয়সালা হয়ে গিয়েছে— বাংলার তখ্‌তে দখলদারি কার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement