খাসেরভেড়ি, জয়মোল্লা, বেড়াবেড়ি, মালপাড়া, মধুসূদনপুর। ২০০৮ থেকেই গ্রামগুলিতে ব্রাত্য বামেরা। ২০১১ সালে সিঙ্গুরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে এক সময়ের বাম দুর্গ। এমনকী এ বারের বিধানসভা ভোটের আগে গ্রামগুলিতে প্রচার করতে পারেননি বাম কর্মীরা। বাধার মুখে পড়ার কথা জানাচ্ছেন সিঙ্গুর কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী রবীন দেব নিজেই।
কিন্তু ভোটের দিন কিছুটা বদলাল ছবিটা। বাধা উড়িয়ে দিলেন জয়মোল্লার বসিরুদ্দিন, বেড়াবেড়ির সুকান্ত ও মধুসূদনপুরের সবিতা সামন্তরা। গ্রামের মধ্যে বাম প্রার্থীকে দেখে না দেখার ভান করলেন না। বরং বাড়ির দাওয়ায় রবীনবাবুকে ডেকে বসালেন। গ্লুকোজ জল দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। হাওয়া করতে এলেন হাতপাখা দিয়ে। গ্রামের মোড়ে তখন শাসক দলের ছেলেদের জটলা।
এই ঘুরে দাঁড়ানোকেই নিজের জিত হিসেবে দেখছেন জোট প্রার্থী রবীন দেব। তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি অবশ্যই বড় দাওয়াই।
কিন্তু শুধুই উর্দির ম্যাজিক নয়। তাঁর কথায়, ‘‘মাসখানেক আগেও এ সব গ্রামে ঢুকতে পারেনি আমাদের ছেলেরা। আর আজ সেখানেই আমাদের ডেকে কথা বলছেন গ্রামবাসীরা। এটাই আমাদের পাওনা।’’ বামেদের বিশ্বাস, এই পরিবর্তনই ভোটবাক্সে তাঁদের প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়াবে।
অঙ্কের হিসেব অবশ্য এই পরিবর্তনের পক্ষে নয়। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে ৩৩ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছিলেন তাঁরা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সেই ব্যবধান ছিল প্রায় ৩০ হাজার।
কিন্তু সেই অঙ্কের চেয়ে আমজনতার আবেগকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন রবীনবাবুরা। ভোটের দিনের কর্মসূচিও সেই আবেগের ভরসাতেই তৈরি করেছিলেন তিনি। শনিবার সকাল আটটায় পৌঁছে
গেলেন সিঙ্গুর বাজারের দলীয় কার্যালয়ে। কর্মীদের থেকে জেনে নিলেন কোন কোন এলাকায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রত্যাশা মতোই টাটাদের কারখানার সংলগ্ন অঞ্চলে তখন নিজেদের দুর্গ সামলাতে নেমে পড়েছেন তৃণমূল কর্মীরা। হাতের ফাইলে সেই সব এলাকার বুথের নাম দেখে নিয়ে নেমে পড়লেন রবীনবাবুও।
বেছে নিলেন ওই এলাকাগুলোই। লাল ধুলো উড়িয়ে কালো এসইউভি ঢুকল একের পর এক গ্রামে। সরু মেঠো পথের দু’পাশে দেওয়ালে দেওয়ালে শাসক দলের গুণগান।
বিরোধীদের দু’চারটে পতাকা ছাড়া আর কোনও চিহ্ন নেই বললেই চলে। কোথাও সটান ঢুকে পড়লেন বুথে। কোথাও দরজায় দাঁড়ানো মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভোট দিয়েছেন কি না। দলীয় কর্মীদের ইশারায় আমল না দিয়ে কথা বললেন
অনিচ্ছুক কৃষকের সঙ্গেও। জোট প্রার্থী জানাচ্ছেন, তৃণমূলের গড়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে ফেলার কর্মসূচি বৃথা যায়নি। দিনের শেষে রবীনবাবু বলেন, ‘‘অধিকাংশ বুথেই প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট হয়েছে।’’ কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি ও সব বুথে নিজেদের এজেন্ট দিতে পারা-এই জোড়া প্রাপ্তির ভরসাতেই বুক বাঁধছেন বাম কর্মীরাও। সঙ্গে আস্থা বাড়াচ্ছে শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এক বাম কর্মীর দাবি, রতনপুরে একটি বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি তৃণমূল।
এই এলাকায় থাকেন পাশের বিধানসভা কেন্দ্র হরিপালের তৃণমূল প্রার্থী বেচারাম মান্না। যাঁর ইন্ধনে সিঙ্গুরের পঞ্চায়েত প্রধানরা তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন বলে
দলীয় সূত্রেই খবর। দলীয় কোন্দলকে অবশ্য আমল দিচ্ছেন না এলাকায় ‘মাস্টারমশাই’ হিসেবে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। আবার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা অস্বীকারও করছেন না। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে নিজস্ব পরিচিতির উপরেই আস্থা রাখছেন তিনি। মাস্টারমশাইয়ের কথায়, ‘‘নেতারা না থাকলেও কিছু আসে যায় না। কর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। শিক্ষক হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বহু দিনের।’’ পরীক্ষার ফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে ১৯ মে পর্যন্ত। কিন্তু সিঙ্গুরে যে পরীক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে হলে পৌঁছতে পেরেছেন, সেটাই বড় কথা বলে মনে করছে বিরোধী জোট। ভোটের দিন এটা তাদের বড় প্রাপ্তি।