(বাঁ দিকে) প্রচারে এনসিপি-র প্রার্থী সুরিজৎ ঘোষ। (ডান দিকে) দেওয়াল লিখছেন তৃণমূল প্রার্থী রচপাল সিংহ। ছবি: দীপঙ্কর দে
মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক নয়। সিপিএম বা কংগ্রেসও নয়। তারকেশ্বরে জোটের হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে শরদ পাওয়ারের দল এনসিপি।
ইতিহাস বলছে, ১৯৭২ সালে এই কেন্দ্রে জিতেছিলেন কংগ্রেসের বলাই শেঠ। পরের বার অর্থাৎ ’৭৭ থেকে আসনটা বামেরাই (ফব) একতরফা হয়ে গিয়েছিল। এখানকার বিধায়ক (অধুনা প্রয়াত) রাম চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী ছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল যথেষ্ট। পরে ওই দলেরই প্রতীম চট্টোপাধ্যায় দমকল মন্ত্রী হন।
২০১১ সালে প্রবল মমতা হাওয়ায় প্রতীমবাবুকে হারিয়ে জেতেন প্রাক্তন আইপিএস রচপাল সিংহ। নিছক বিধায়ক নয়, জিতেই পূর্ণমন্ত্রী বনে যান তিনি। গোড়া থেকেই রাজ্যের পর্যটন ঢেলে সাজা নিয়ে রাজ্যবাসীকে নানা স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। পর্যটন দফতরের দায়িত্ব রচপালের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু পর্যটনের উন্নতিতে সে ভাবে কোনও কাজ করতে না পারায় দফতর খোয়াতে হয় শৈব্যতীর্থের বিধায়ককে। পর্যটনের থেকে অনেক কম গুরুত্বের পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী করে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
মন্ত্রিসভায় যাঁর এমন পারফরম্যান্স, এলাকায় বিধায়ক হিসেবে তিনি কতটা নম্বর পাবেন?
নিন্দুকেরা বলেন, গোটা তারকেশ্বর বিধানসভা ঢুঁড়েও এমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ দেখা যাবে না যাতে বিধায়কের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছে। বিধায়ক তহবিলের টাকায় বেশ কিছু রাস্তা হয়েছে, আলো বসেছে। স্কুলে বেঞ্চ দিয়েছেন। জলের কল বসেছে কিছু জায়গায়। কিন্তু সে সব প্রাথমিক কাজের বাইরে বিধায়য়ের অবদান? রচপালের অবশ্য দাবি, রাস্তাঘাট তৈরি করা ছাড়াও ৮টি অ্যাম্বুল্যান্স, একটি শববাহী গাড়ি দিয়েছেন তিনি। তারকেশ্বর মন্দিরের প্রবেশপথের তোরণ তৈরি করেছেন। মন্দিরের চারপাশ আশপাশ আলো দিয়ে সাজিয়েছেন। তারকেশ্বরের দুধপুকুর স্বর্ণমন্দিরের জলাশয়ের আদলে সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় সে কাজ করতে পারেননি।
তৃণমূলের অন্দরমহল বলছে, কলকাতার বাসিন্দা রচপালকেও কখনওই নিয়মিত পায়নি তারকেশ্বর। সপ্তাহান্তে এসেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সে ভাবে যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। উল্টে পাঁচ বছরে তারকেশ্বরের নানা প্রান্তে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। বলাবাহুল্য আইপিএস বিধায়ক সে সব সামাল দিতে পারেননি। বা বলা ভাল, চোখ বুজে থেকেছেন। ফলে দলের নেতাদের মধ্যে সমস্যা বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে এ বার রচপালের প্রচারেও। এক পক্ষের লোক গেলে অন্য পক্ষের অনুগামীরা সেখানে ভিড়ছেন না। দিন কয়েক আগে প্রার্থীর দলীয় কার্যালয়েই দু’পক্ষের মধ্যে স্বপন সামন্ত ও বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল বাধে। স্বপনবাবুর ঘনিষ্ঠ এক কর্মীকে ধাক্কাধাক্কি করা হয় বলে অভিযোগ। পাল্টা পুরপ্রধান স্বপন সামন্তকে ‘সিপিএমের দালাল’ বলে কটাক্ষ করেন এক নেতা। যদিও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এমন আবহেও রচপালের দাবি, ‘‘মানুষ তাঁর এবং তৃণমূলের পাশে আছে। যাঁরা গোলমাল করছেন, তাঁদের জনভিত্তি নেই। যে যাই বলুন, আমার প্রধান শক্তি উন্নয়ন আর জনসংযোগ।’’
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব জর্জরিত তৃণমূলকে বাগে আনতে বিরোধীদের সম্মিলিত শক্তি কতটা তৈরি?
অনেকেই ভেবেছিলেন, বামেদের তরফে সিপিএম বা মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কাউকে প্রার্থী করলে রচপালের পক্ষে তা কঠিন ঠাঁই হবে। কংগ্রেসও এখানে প্রার্থী দাঁড় করাতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জোট সমীকরণে এনসিপি-কে আসনটি ছেড়েছে বামেরা। ওই দলের প্রার্থী হিসেবে ‘বহিরাগত’ বাসিন্দা রাজেশ শর্মার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু না–পসন্দ হওয়ায় বাম বা কংগ্রেস নেতাদের চাপে শেষ পর্যন্ত রাজেশের বদলে স্থানীয় বাসিন্দা সুরজিৎ ঘোষকে প্রার্থী করা হয়।
হুগলি জেলার রাজনীতিতে অজ্ঞাতকুলশীল এনসিপি-র হয়ে কতটা তৎপর হয়ে মাঠে নামবেন বাম এবং কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা তা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েছেই। সিপিএমের অবশ্য দাবি, তারা তৈরি। তারকেশ্বরের সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, ‘‘তৃণমূলের ‘অপশাসন’ থেকে মুক্তি পেতে আমরা প্রাণপণে লড়ব।’’ সুরজিৎবাবু অপেক্ষাকৃত তরুণ। কেশবচক পঞ্চায়েতের শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এলাকায় বামপন্থী হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতিও রয়েছে। সিপিএম নেতা স্নেহাশিস রায় বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে কোন দল প্রার্থী দিল, সেটা বড় কথা নয়। আসল ব্যাপারটা হল তৃণমূলকে সরাতে আমরা সবাই একজোট হয়ে লড়ব। আর সুরজিৎ খুব ভাল ছেলে।’’ কংগ্রেস নেতা শৈল ঘোষের কথায়, ‘‘তৃণমূল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার। ওদের হটাতে আমরা হাতে হাত রেখেই লড়ব।’’
২০১১ সালে রচপাল ৯৭ হাজার ২২টি ভোট পেয়েছিলেন। প্রতীমবাবু পেয়েছিলেন ৭১ হাজার ৫৫টি ভোট। রচপাল ২৫ হাজার ৪৭২ ভোটে জিতেছিলেন। এই অবস্থায় এ বার বাম-কংগ্রেস জোটের বিরুদ্ধে লড়াই যে টাফ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রাক্তন আইপিএস।