হলদিয়া মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের সামনে তৃণমূল-সিপিএমের গোলমাল। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।
শাসকের ঘাঁটিতেও প্রতিরোধের ছবি!
লক্ষ্মণ শেঠের জমানা আর নেই। একদা ‘লাল গড়’ হলদিয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই তৃণমূলের আধিপত্য। কিন্তু সেই শহরই শুক্রবার দেখল মনোনয়নের সময় গোলমালের জেরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেস জোটের কর্মী-সমর্থকদের রুখে দাঁড়ানোর দৃশ্য। এমনকী পুলিশকে মারধরের অভিযোগও উঠল জোট কর্মীদের বিরুদ্ধে।
জোট হওয়ায় এ বার গোড়া থেকে শক্তি বেড়েছে বাম ও কংগ্রেসের। তার উপর বৃহস্পতিবারই কলকাতায় এসে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার নসিম জৈদী খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো-কজের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে জোটের শক্তি আরও বেড়েছে। এবং তার পরিণতিতেই হলদিয়ার মতো তৃণমূলের দাপটের এলাকাতেও তারা প্রতিরোধ গড়তে পারছে বলে জেলার রাজনৈতিক মহলের অভিমত।
শুক্রবার হলদিয়ার মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে জোট, তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বাম ও বিজেপি প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল। সেই মতো সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিতে আসেন হলদিয়ার সিপিএম প্রার্থী তাপসী মণ্ডল। মনোনয়ন জমা দিতে কার্যালয়ে ঢুকে যান তাপসীদেবী। সেই সময় মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের প্রবেশপথের বাইরে পথসভা করছিল সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা। দুপুর সওয়া ১২টা নাগাদ মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিতে আসেন মহিষাদলের তৃণমূল প্রার্থী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার।
অভিযোগ, তৃণমূলের লোকেরা পুলিশের কাছে জানতে চায়, সিপিএমকে কেন সভার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই সময় পুলিশ সিপিএম নেতা-কর্মীদের সভা বন্ধ করতে বলেন। সিপিএম কর্মীদের বোঝাতে যান সুতাহাটা থানার ওসি শীর্ষেন্দু দাস। যদিও পথসভা করার দাবিতে অনড় থাকে সিপিএম। অভিযোগ, এ নিয়ে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের বচসা বাধে। অভিযোগ, সেই সময় এক সিপিএম সমর্থক সুতাহাটা থানার ওসির গায়ে হাত তোলেন। তারপরেই পুলিশ সিপিএম সমর্থকদের হঠাতে লাঠিচার্জ করে বলে অভিযোগ। ওসিকে মারার অভিযোগে সামসুদ্দিন শাহকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গোলমালের জেরে প্রথমে পিছু হঠে সিপিএম। পরে তাঁরা রুখে দাঁড়ায়। তারপরে সিপিএম ও তৃণমূল সমর্থকদের গোলমালে এলাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। গণ্ডগোলের সময় হলদিয়ার এসডিপিও তন্ময় মুখোপাধ্যায়ও আহত হন বলে অভিযোগ। বিশাল পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এলাকা শান্ত হলে সিপিএম প্রার্থী তাপসীদেবী মিছিল করে বেরিয়ে যান। সিপিএমের মিছিল থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। তাপসীদেবীর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ অন্যায়ভাবে আমাদের ছেলেদের উপর হামলা করেছে।’’ সিপিএম নেতা অচিন্ত্য শাসমলের অভিযোগ, ‘‘সিপিএম প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে কেন তৃণমূলের মিছিল ওই এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশই ইচ্ছাকৃত ভাবে এই গোলমাল বাধিয়েছে।’’ হলদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজি সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এ দিন মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় সিপিএমকে কোনও সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারপরেও ওঁরা সভা করে। পুলিশ সভা বন্ধ করতে বললে গোলমাল বাধে।’’
হলদিয়ার মহকুমাশাসক পূর্ণেন্দু নস্কর জানান, ‘‘এ দিন হলদিয়া, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম, সিপিআই, তৃণমূল ও বিজেপির মোট আট জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।’’ মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে পুলিশ আলোচনা করেই ঠিক করেছিল, ‘কে কোন সময় মনোনয়ন জমা দিতে আসবেন। একইসময়ে দু’টি মিছিল কী করে এল, তা খতিয়ে দেখা হবে।’’
সিপিএমের মিছিল চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি সাময়িক ভাবে শান্ত হয়ে যায়। মনোনয়ন দিতে যান তৃণমূল প্রার্থী সুদর্শনবাবু। দুপুর ১টা নাগাদ মনোনয়ন জমা দিতে যান নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী ও হলদিয়ার তৃণমূল প্রার্থী মধুরিমা মণ্ডল। শুভেন্দুবাবু আগেই মনোনয়ন জমা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শুভেন্দুবাবু বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামের মানুষের আশীর্বাদ নিয়েই মনোনয়ন জমা দিতে এসেছি। এ বার উন্নয়নের পক্ষেই ভোট হবে।’’
শুভেন্দুবাবু চলে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সুদর্শনবাবু। সেই সময় সুদর্শনবাবুর অনুগামীরা সাংবাদিকদের উপর চড়াও হয়ে মারধর করে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, একজন সাংবাদিকের জামাও ছিঁড়ে দেওয়া হয়। নষ্ট করে দেওয়া হয় এক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে তড়িঘড়ি এলাকা ছাড়েন তৃণমূল প্রার্থী। সুদর্শনবাবু চলে যাওয়ার পরও এবিপি আনন্দর সাংবাদিককে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়। মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে ঢুকে রেহাই পান সাংবাদিকেরা। হলদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজি সামসুদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলে গেলে তৃণমূল কর্মীরা পালায় বলে অভিযোগ। হলদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘এই ঘটনার তদন্ত করা হবে। ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখে দোষীদের ধরা হবে।’’