মঙ্গলকোটের সভায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ সাহানেওয়াজ। ছবি :অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
তুমি হতে পারো শাসকদলের সর্বশক্তিমান নেত্রী। কিন্তু, আমার এলাকায় আমিই রাজা!
ভোটের নানুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার্তাটা দিয়ে দিলেন কোনও এক কাজল শেখ। দিলেন দিনভর নিজের এলাকায় না থেকে। গোপন ডেরা থেকে ভোট পরিচালনা করে। এমনই দাপট দেখালেন কাজলের অনুগামীরা যে, নানুরের এক বিস্তীর্ণ এলাকায় রবিবার ট্যাঁ ফুঁ করতে পারলেন না তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। বহু বুথে এজেন্ট দিতে পারল না শাসকদল। যখন দিল, ততক্ষণে খেল খতম! নিজের এলাকায় ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোট করিয়ে নিয়েছেন কাজল।
সেই ভোট পেল কারা?
প্রশ্নটা শুনে মুচকি হেসে বললেন কাজলের এক অনুগামী, ‘‘যাদের পাওয়ার, তারাই পেয়েছে। এ বার বুঝে নিন।’’
বুঝে গিয়েছিলেন মমতাও। বুঝেছিলেন, পঞ্চায়েত ও লোকসভার তুলনায় নানুরে এ বার ‘অন্য রকম’ ভোট হচ্ছে।
তাই তো রবিবার দুপুর ২টো ২৫ নাগাদ বীরভূমের নানুর লাগোয়া বর্ধমানের মঙ্গলকোটের জনসভায় মঞ্চে উঠেই কেতুগ্রামের দলীয় প্রার্থী শেখ সাহানেওয়াজকে (যিনি কাজলের আপন দাদা) তৃণমূল নেত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নানুরে ভোট কেমন হচ্ছে?’ সাহানেওয়াজ বললেন, ‘সকালে ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তার পরে জানি না, কেমন হচ্ছে।’ মমতা বলে ওঠেন, ‘নানুরে বুথে বুথে তৃণমূলের এজেন্ট নেই। এজেন্টদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও এজেন্ট দেওয়া হয়নি। এগুলো কি ঠিক হচ্ছে?’
সাহানেওয়াজের জবাব, ‘ও (কাজল শেখ) তো এলাকায় নেই অনেক দিন হল। কী হয়েছে, আমি বেশি কিছু বলতে পারব না।’ এই জবাব সন্তুষ্ট করতে পারেনি মমতাকে। মুখ সরিয়ে চেয়ারে বসে বলেন, ‘এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি কোনও কথা শুনব না।’ সাহানেওয়াজ বলেন, ‘আমি দেখছি। খোঁজ নিচ্ছি।’
নানুরে ফোন গেল। ছবিটাও বদলাল ধীরে ধীরে।
কিছু পরেই পাপুড়ির পথে গাড়ি ছুটিয়ে যেতে দেখা গেল গদাধর হাজরাকে। পিছনে কয়েকটি গাড়ি। গাড়ি গিয়ে থামল পাপুড়ি গ্রামের (এখানেই বাড়ি কাজলের) ‘আলোর দিশারি’ প্রাথমিক স্কুলের সামনে। সেখানে তিনটি বুথ। সকাল থেকেই বুথে তৃণমূলের কোনও এজেন্ট ছিল না। তিন গ্রামবাসীকে নামিয়ে বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারদের গদাধর বললেন, এঁরা এজেন্ট হবেন। শুনে এক অফিসার বললেন, ‘‘৭ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে। এত দেরিতে...।’’ গদাধর শুনতে চাননি। শেষে সেক্টর অফিসারের সম্মতি নিয়ে এজেন্ট বসল। জানা গেল, প্রায় ৬৮ শতাংশ ভোট তখন পড়ে গিয়েছে।
একই ছবি বনগ্রামে। বুথে এজেন্ট তো ঢোকানো হলো। কিন্তু তাঁর কাছে কোনও ভোটার তালিকাই নেই! প্রিসাইডিং অফিসার বলেও ফেললেন, তালিকা না থাকলে উনি করবেন কী? শুনে গদাধরের জবাব, ‘‘আমার এজেন্ট কী করবে না করবে, আমি বুঝব।’’ বেচারা এজেন্ট রামপ্রসাদ সূত্রধর। বললেন, ‘‘ভাত খেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে তুলে বলা হল, চলো এজেন্ট হবে।’’
স্থানীয় বাসিন্দারাই জানালেন, বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীর পিছনে রয়েছে কাজলের অদৃশ্য হাত। তাই তাঁর দখলে থাকা গ্রামে তৃণমূলের এজেন্ট হয়ে কাজলের রোষে পড়তে চাননি অনেকেই। সিঙ্গি, জলুন্দি, পাপুড়ি, চারকল, নওয়ানগর-কড্ডা—কাজলের দখলে থাকা এই পঞ্চায়েত এলাকার গোটা পঞ্চাশেক বুথে এজেন্ট ছিল না তৃণমূলের। ৫০টি বুথ মানে অনেক ভোট। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদাও দাবি করলেন, নানুরের ৩০৮টি বুথের মধ্যে ৩৪টিতে বাম-কংগ্রেস জোট এজেন্ট দিতে পারেনি। আর ৫১টি বুথে তৃণমূলের কোনও এজেন্ট ছিল না।
অথচ, পঞ্চায়েত কিংবা লোকসভায় নানুরের কোনও বুথে বিরোধীরাই এজেন্ট দিতে পারেনি। তখন গদাধর-কাজলের ভাব ছিল। এখন উল্টো ছবি। কাজলের পণ, গদাধরকে জিততে দেবেন না। সেটা জানেন তৃণমূল প্রার্থীও। তাই অভিযোগ করছেন, ‘‘শনিবার রাতে ওই সব এলাকায় আমাদের এজেন্টদের ভয় দেখিয়েছে কাজলের দলবল।’’ যা শুনে কাজলের অনুগামীরা বলছেন, দেওয়ালের লিখন বোধহয় পড়তে পেরেছেন গদাই হাজরা।