ভোটের মুখে শহরে সক্রিয় কেন্দ্রীয় বাহিনী।
ভোটের আগের দিন কোমর বেঁধে আসরে নামল দু’পক্ষই!
এক দিকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নাকা-তল্লাশি, পুলিশি টহল। স্পর্শকাতর এলাকায় টহল দিলেন খোদ পুলিশ কমিশনার। আবার মাঠে নেমে গিয়েছেন ‘দাদা’রাও। কাশীপুর বা বেলেঘাটা, ভোটারদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে বিরোধীরা।
বুধবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ হাওড়া ব্রিজে একটি ছোট ম্যাটাডর থেকে বেআইনি বিস্ফোরক-সহ অমিত সাউ ও প্রদীপ রায় নামে দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই সব বিস্ফোরক প্রাণঘাতী নয়। এগুলি মূলত জঙ্গল বা খোলা জায়গায় হেলিকপ্টারকে সঙ্কেত দেখাতেই ব্যবহার করা হয়। এর আগে কলকাতায় এমন ধরনের বিস্ফোরক মেলেনি। এ দিন তল্লাশি হচ্ছে দেখে গাড়িটি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ গাড়িটি আটক করে তল্লাশি করার সময়ে ভাঙাচোরা লোহার জিনিসপত্রের ভিতর থেকে ফুটখানেক লম্বা রকেটের মতো একটি জিনিস এবং ১০৫টি বিস্ফোরক পাওয়া যায়। সেগুলির কোনও লাইসেন্সও ছিল না। অমিত এবং প্রদীপ জেরায় পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বলেও লালবাজারের দাবি।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের সন্দেহ, ভোটে হাঙ্গামার সময়ে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যেই ওই বিস্ফোরক শহরে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ময়দান এলাকা থেকে ছ’লক্ষ টাকা-সহ এক জনকে আটকও করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
রেড রোডে তল্লাশির সময়ে নগদ ৬ লক্ষ টাকা পাওয়া গেল সোমেন মিত্র নামে এই মোটরবাইক-আরোহীর কাছে।ছবি : রণজিৎ নন্দী
বীরভূমের নির্বাচনের দিন থেকেই রাজ্যে সক্রিয়তা বেড়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের। নিরাপত্তায় দেখা মিলেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীরও। লালবাজারের অন্দরের খবর, নির্বাচন কমিশনের গাইডলাইন মেনে চলার নির্দেশই দিয়েছেন বাহিনীর কর্তারা। সেই মতোই কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পুলিশ শহরে টহল-তল্লাশি চালিয়েছে। কিন্তু এ সবের মধ্যেও বেলেঘাটা রয়েছে বেলেঘাটাতেই। মঙ্গলবার রাতে বেলেঘাটা মেন রোডে এক সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। অভিযোগের তির শাসক দল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দিকে। সৌমেন দাস নামে এক তৃণমূল নেতা মিয়াঁবাগান, নবাববাগান এলাকায় ভোটারদের গিয়ে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ। ২০১৫ সালে পুরসভা ভোটে বেলেঘাটা এলাকাতেই শাসক দলের বিরুদ্ধে নির্বিচারে রিগিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। এ বার কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা দেখেই ভোটারদের বাড়িতে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন বিরোধীরা।
ওই সব এলাকার বাসিন্দারা জানান, তাঁদের বুথে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কমিশনের ভোটার স্লিপও তাঁরা পাননি। যদিও এই স্লিপ ভোটারদের পৌঁছে দেওয়া বুথ লেভেল অফিসারের কাজ। বেলেঘাটার দু’টি স্কুলে গিয়ে ওয়েবক্যামেরা নষ্ট করার চেষ্টার অভিযোগও শাসক দলের বিরুদ্ধে উঠেছে। তবে দু’ক্ষেত্রেই পুলিশ সক্রিয় হওয়ায় ক্যামেরা নষ্ট হয়নি। সব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে তৃণমূল। ঘটনার কথা শুনে মিয়াঁবাগান ও নবাববাগানে গিয়েছিল পুলিশও। লালবাজার সূত্রের খবর, সৌমেন এলাকার দাগি দুষ্কৃতী রাজু নস্করের শাগরেদ। সে গোলমাল পাকাবে না বলে পুলিশে মুচলেকা দিয়েছিল। অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে তাঁর খোঁজ চলছে। বেলেঘাটায় জোট প্রার্থী রাজীব বিশ্বাস অভিযোগ তোলেন, নারকেলডাঙা মেন রোডে একটি বাড়িতে এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল পার্টি অফিসে শাসক দলের আশ্রয়ে গুন্ডারা ডেরা বেধেছে। পাশাপাশি, বেলেঘাটার বিভিন্ন বস্তিতে ঢুকে তৃণমূলের গুন্ডারা ভয় দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ তাঁর। এ সব জানিয়ে ডিসি ইএসডি-র কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে জানান রাজীববাবু।
পুরভোটের আগে উত্তপ্ত হয়েছিল কাশীপুরও। সেই গোলমালে নাম জড়ানো স্বপন চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে এ দিন ফের ভোটারদের শাসানোর অভিযোগ করেছেন কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা ঘোষ। তাঁর অভিযোগ, শুধু সিপিএম সমর্থক নয়, সাধারণ ভোটারদেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগও জানিয়েছেন কনীনিকাদেবী। একটি সূত্রের খবর, এ দিন বৌবাজার এলাকাতেও রাতের দিকে কিছু দুষ্কৃতী জড়ো হয়েছে। মানিকতলা এলাকাতেও বহিরাগতরা ঢুকে ভয় দেখায় বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকার লোকজন। স্থানীয় থানার পুলিশ বলে, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
উত্তর কলকাতায় ভোট শুরুর আগে উত্তপ্ত দক্ষিণ কলকাতাও। এ দিন সকালে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সির পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তা নিয়ে কালীঘাট থানা এবং নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা তরুণ অগ্রবালের অভিযোগ, ‘‘শুধু হরিশ চ্যাটার্জি নয়, কিড স্ট্রিট, কলিন্স লেন, পার্ক স্ট্রিটেও পোস্টার, হোর্ডিং ছেঁড়া হয়েছে। দেওয়াল লিখন মুছে দেওয়া হয়েছে।’’ এর প্রতিবাদে পরে দীপা দাশমুন্সি এবং জোট সমর্থকেরা মিছিলও করেন। বন্দর এলাকার পাহাড়পুর ও তারাতলা রোডের সংযোগস্থলে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ঝামেলা বাধে। পুলিশ সূত্রের খবর, ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রঞ্জিত শীলের সঙ্গে ৮০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মহম্মদ আনোয়ার খানের বিবাদের জেরেই এই গোলমাল। তার জেরে পথও অবরোধ হয়। রঞ্জিতবাবু এবং আনোয়ার, দু’জনেই এই বিবাদের কথা অস্বীকার করেছেন।
উত্তর কলকাতায় ভোট শুরুর আগের দিন শহরে নানা হুমকি-সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকলেও পুলিশ অবশ্য বলছে, নির্বাচনের দিন শহর শান্তিপূর্ণ থাকবে। মোতায়েন করা হয়েছে ৬১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। রয়েছে অন্তত সাত হাজার পুলিশ। এ দিন সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নাকা-তল্লাশি শুরু হয়েছিল। বেলেঘাটার দু’টি স্কুল এবং বিভিন্ন এলাকায় গোলমালের অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে যান পুলিশের পদস্থ কর্তারা। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। বিকেলে বেলেঘাটা-সহ বেশ কয়েকটি এলাকা টহল দেন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র। লালবাজারের অনেকেই বলছেন, ভোটের আগে রাজীব কুমারকে কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে যে বার্তা দিয়েছিল কমিশন, তা পুলিশের সর্বস্তরে ছড়িয়েছে। ভোটের সময়ে শাসক সংশ্রব এড়়িয়ে চলতে বলা হয়েছে অন্তত দু’জন ওসিকে। এ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং কলকাতা পুলিশকে নিয়ে একাধিক রকমের দল গড়া হয়েছে। সেগুলি আজ, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পথে নামবে। লালবাজারের অনেকে বলছেন, পুরভোটে দুষ্কৃতীদের লাগামছাড়া হতে দেওয়ায় মুখ পুড়েছিল পুলিশেরই। দুষ্কৃতীদের গুলিতে জখম হয়েছিলেন খোদ পুলিশের এসআই জগন্নাথ মণ্ডল। ‘‘এ বার ভোটে কোনও বেচাল সহ্য করা হবে না,’’ বলছেন কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা।
বিরোধীরা অবশ্য এখনই পুলিশকে সার্টিফিকেট দিতে রাজি নয়। তাঁরা বলছেন, ভোটের দিন না পেরোলে কিছুই বলা উচিত নয়।