চেঁচিয়ে উঠল, হা রে রে রে রে রে

মনে হচ্ছিল বুঝি ডাকাত পড়েছে! আগে ডাকাতেরা আসত ঘোড়ায় চেপে। আর দক্ষিণ শহরতলির বাঘা যতীন জি-ব্লক, ফুলবাগান, রবীন্দ্রপল্লিতে রবিবার রাতে ডাকাতেরা এসেছিল মোটরবাইকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০৪:০৯
Share:

রাতে পাড়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতী বাহিনী। সিসিটিভি-তে ধরা পড়েছে এই ছবি।

মনে হচ্ছিল বুঝি ডাকাত পড়েছে!

Advertisement

আগে ডাকাতেরা আসত ঘোড়ায় চেপে। আর দক্ষিণ শহরতলির বাঘা যতীন জি-ব্লক, ফুলবাগান, রবীন্দ্রপল্লিতে রবিবার রাতে ডাকাতেরা এসেছিল মোটরবাইকে।

রঘু ডাকাতেরা গ্রামেগঞ্জে হানা দিত মুখে কাপড় বেঁধে। হা-রে-রে-রে ডাক আর ঘোড়ার খুরের আওয়াজে কেঁপে উঠত গোটা এলাকা।

Advertisement

রবিবার রাতে বাইক চেপে আসা ডাকাতদের মুখে কালো কাপড় ছিল না। কিন্তু হো হো চিৎকার করতে করতে আশপাশের বাড়ির দেওয়ালে লাঠি মারতে মারতে যে ভাবে ওরা এগোচ্ছিল, তাতে অদ্ভুত এক ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল এলাকায়। কোন কোন বাড়িতে হানা দেওয়া হবে, তা আগে থেকেই ঠিক করে ডাকাতেরা। শনিবারের ডাকাতেরাও বাড়ি নির্দিষ্ট করে এসেছিল। তবে লুঠ করার জন্য নয়। ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে, বাড়ির লোকেদের মারধরের উদ্দেশ্য ছিল তাদের।

ডাকাতেরা অবশ্য আগে থেকে খবর দিয়ে দিন-তারিখ ঘোষণা করে হানা দিত। এদের সেই সাহসটা ছিল না। রাত ন’টা নাগাদ বাইকে চেপে লাঠি, র়ড হাতে শ’খানেক ডাকাতের দল এসেছিল হঠাৎ করেই।

ডাকাতদের কোনও রাজনৈতিক পরিচয় থাকত না। এদের ছিল। অভিযোগ, ডাকাতেরা তৃণমূলের আশ্রিত। আর আক্রান্তেরা সকলেই পরিচিত সিপিএম নেতা বা কর্মী।

আগে থেকে জানিয়ে এসেও ডাকাতেরা বিনা প্রতিরোধে ডাকাতি করে চলে যেত। শনিবারের ডাকাতেরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়ল। অনেকেই মোটরবাইক ফেলে রেখে দে ছুট।

এলাকার ৫০ বছরের বাসিন্দা, ৮৫ বছরের বৃদ্ধা বেলারানি দে-র কথায়, ‘‘এত দিন এখানে আছি। এমন ভয় কখনও পাইনি।’’ স্মৃতির পাতা উল্টে বৃদ্ধা বলেন, ‘‘আগে এখানে রাস্তাঘাট ছিল না। বেশির ভাগ বাড়িতে বিজলি বাতি ছিল না। ধানখেত ছিল। নকশাল আমলে মানুষ কোতল করার জন্য নিয়ে আসা হতো এখানে। চোরের উপদ্রব ছিল। কিন্তু এমন ভয়ের পরিবেশ আগে কখনও হয়নি।’’

প্রথমে ছিল ১০-১২টা বাইক। বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৪০টায়। কোনওটায় তিন জন। কোনওটায় দু’জন। সওয়ারিদের হাতে বাঁশ, লাঠি, লোহার রড, হকি স্টিক। পুলিশের সামনে দু’ঘণ্টা ধরে ওই ডাকাতেরা তাণ্ডব চালাল ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘা যতীন জি ব্লক, ফুলবাগান, রবীন্দ্রপল্লি, কেন্দুয়ায়।

স্থানীয় এক সিপিএম নেতার বাড়িতে ভাঙচুরের পরে।
ছবিটি তুলেছেন সুমন বল্লভ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ঘটনার শুরু রাত সাড়ে আটটায়, জি-ব্লকে। প্রথমে হামলা হল যাদবপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর পোলিং এজেন্ট সুজন দত্তের বাড়িতে। সুজন দত্তকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হন স্থানীয় সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদক বুদ্ধদেব ঘোষ এবং সিপিএম কর্মী কমল মজুমদার। দুষ্কৃতীরা কমল মজুমদারকে প্রথমে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারল বুকে, পায়ে ও হাতে।

এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সুজন দত্তের বাড়ি ভাঙচুরের পরে ওই বাহিনী চিৎকার করতে করতে এগিয়ে চলে ফুলবাগানের দিকে। একে একে ভাঙচুর করে ডিওয়াইএফআই কর্মী সুজয় সাহা, বুদ্ধদেব ঘোষ, কমল মজুমদার এবং গৌরাঙ্গচন্দ্র সাহার বাড়ি। বুদ্ধদেববাবুর অশীতিপর বৃদ্ধা মা তখন খাটে শুয়ে ছিলেন। আচমকাই জানলার কাচ ভেঙে ইটের টুকরো এসে পড়ে তাঁর গায়ে। পরমুহূর্তেই বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে ইট-পাথর। বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে যায় কাচের ভাঙা টুকরো। কমলবাবুর বাড়িতে ঢুকেও একই কায়দায় হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। ভেঙে দেওয়া হয় তাঁদের বিদ্যুৎ এবং জলের লাইনও।

পুলিশের সামনে এই ঘটনা ঘটতে দেখে প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে আশপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন বাসিন্দারা। পরিচিত তৃণমূল সমর্থক বাড়ির লোকেরাও ছিলেন তার মধ্যে। মানুষের সম্মিলিত জোট তাড়া করে মোটরবাইক বাহনীকে। আর মানুষের পাল্টা প্রতিরোধ দেখে হঠাৎই সক্রিয় হয় পুলিশও। তারা লাঠিচার্জ শুরু করে। তাড়া খেয়ে জনা কুড়ি দুষ্কৃতী মোটরবাইক ছেড়েই পালিয়ে যায়।

অভিযোগ, পালিয়ে যাওয়ার পথে ফের তারা ভাঙচুর করে সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য সুশান্ত নস্করের বাড়ি। সুশান্তবাবুর অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত দাদা প্রশান্ত নস্করের উপরেও দুষ্কৃতীরা হামলা চালাতে কসুর করেনি বলে অভিযোগ।

কাউকে কি চিনতে পারলেন? প্রতিরোধ গড়ায় মুখ্য ভূমিকা নেওয়া এক মহিলার জবাব, ‘‘একেই রাত। তার উপরে আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কাউকে চিনতে পারিনি।।’’ যেখানে কমল মজুমদার, গৌরাঙ্গ সাহাদের বাড়ি, ঠিক তার গা ঘেঁষেই কলকাতা পুরসভার ১০১ নম্বর ওয়ার্ড অফিস। সেখানেই বসেন ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত। এলাকার এক মহিলার কথায়, ‘‘এখানে যতক্ষণ কাউন্সিলর থাকেন, তাঁকে ঘিরে থাকে বাইরের কিছু যুবক। ওদের আমরা চিনি না। রবিবারের হামলায় ওরা কিন্তু জড়িত থাকতেই পারে।’’

সোমবার সকালে ওয়ার্ড অফিস ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল পুলিশের গাড়ি। আশপাশে স্থানীয় মহিলাদের জটলা থেকে সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ করে ছুটে এল মন্তব্য, ‘‘পুলিশ কতক্ষণ থাকবে, তা জানি না। এ সব গুন্ডাদের শায়েস্তা করতে এ বার দেখছি আমাদেরই দা-বঁটি নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement