সালটা ২০০১। ১৩ মার্চ সামনে এসেছিল তহলকার বিশেষ স্টিং অপারেশন ‘ওয়েস্ট এন্ড’। যার জেরে বিড়ম্বনায় পড়ে তৎকালীন এনডিএ সরকার।
সে দিনটা ছিল মার্চের তেরো তারিখ! আজ চোদ্দো! মাঝে কেটে গিয়েছে পনেরোটা বছর!
দেড় দশক আগে ফ্ল্যাশ ব্যাকে সেই ‘সিনটায়’ ফিরে তাকালে দেখা যায়, নয়াদিল্লির ১১ নম্বর অশোক রোডে বিজেপির সদর দফতর। ঈষৎ ঝাপসা ছবি। তবু কথোপকথনে বোঝা যাচ্ছে, অস্ত্র ব্যবসায়ীর পরিচয় দিয়ে আসা আগন্তুকের থেকে নগদ এক লক্ষ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন বঙ্গারু লক্ষ্মণ। ভারতের ইতিহাসে সেই প্রথম স্টিং অপারেশন! তহলকা কাণ্ড বলে যার খ্যাতি! ক্যামেরার সেই হুল-দংশনে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল জাতীয় রাজনীতি। মুখ পুড়েছিল বাজপেয়ী সরকারের।
কেন্দ্রে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের শরিক তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৎকালীন রেলমন্ত্রীও বটে! রাজনীতির উঠোন কলুষমুক্ত করার দাবিতে তিনি হুমকি দেন, বিজেপি সভাপতির পদ থেকে বঙ্গারু লক্ষ্মণ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে জর্জ ফার্নান্ডেজ ইস্তফা না দিলে তিনি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন!
দেড় দশক পর অভিযোগের সেই পাঁকে এ বার খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল! ভিডিও ফুটেজটি খাঁটি না তাতে কারসাজি রয়েছে, এখনও সেই পরীক্ষা না হলেও সন্দেহ নেই ক্যামেরার হুল এ বার ফুটেছে তৃণমূলের গায়ে! সীতারাম ইয়েচুরিরা আজ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘এ বার কী করবেন তৃণমূল নেত্রী! রাজনীতিতে নৈতিকতা রক্ষার স্বার্থে যে জেহাদ সে দিন তিনি দেখিয়েছিলেন, কই এ বার দেখান!’’
ভোটের মুখে বাংলার শাসক দলের বিরুদ্ধে এত বড় স্টিং অপারেশনের পর মমতার দল আজ যে ভাবে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পাচ্ছেন, আসলে সেটি পেয়েছিলেন বাজপেয়ীও! রাজনীতির হয়তো সেটাই রীতি! অথবা অভিযোগ ঝেড়ে ফেলে জোর করে সাহসী মুখ দেখানোর জন্য বাসর ঘরের একমাত্র ছিদ্রপথ হয়তো সেটাই।
শুধু তহলকা কাণ্ড নয়, বাজপেয়ী জমানায় বিজেপিকে স্টিংয়ের ধাক্কা খেতে হয়েছিল দু’-দু’বার। প্রথমটা, অর্থাৎ তহলকা কাণ্ড অবশ্যই আড়ে-বহরে ছিল বড়। তার পর ২০০৩ সালে ছত্তীসগঢ়ে বিধানসভা ভোটের আগে অার এক স্টিং অপারেশন হইচই ফেলে দিয়েছিল দেশ জুড়ে। বিশেষ করে বাজপেয়ী ও সঙ্ঘ পরিবারের আস্থাভাজন দিলীপ সিংহ জুদেওয়ের ওই ‘ডায়লগ’ এখনও কিংবদন্তি। দিলীপ ছিলেন ছত্তীসগঢ়ে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। ভোটের ঠিক মুখে এক স্টিং অপারেশনে দেখা যায় জনৈক ব্যবসায়ীর হাত থেকে নগদ টাকা গুণে নিচ্ছেন তিনি। আর সেই টাকা গুনে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে দিলীপ বলেছিলেন, ‘পয়সা খুদা তো নেহি, মগর খুদা কি কসম, খুদা সে ভি কম নেহি!’’ স্টিংয়ের জন্য ছত্তীসগঢ়ের কংগ্রেস নেতা অজিত জোগীর ছেলে অমিতের বিরুদ্ধে তখনও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। তবে যা-ই হোক, সে যাত্রায় দিলীপের আর মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া হয়নি। তাঁকে সরিয়ে উঠে এসেছিলেন ছত্তীসগঢ়ের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী রামন সিংহ! মজার ব্যাপার হল, ইদানীং এক বিধায়ক কেনাবেচার ঘটনায় এ বার আঁচ এসে পড়েছে রামনের পরিবারের ওপরেও। তবে এখানে ভিডিও ফুটেজ নেই। শুধুই অডিও টেপ! যা নিয়ে তদন্ত চলছে এখনও। আরও যেটা বলার, ওই কেনাবেচায় রামনের পরিবারের সঙ্গে অজিত ও তাঁর ছেলে অমিতের যোগ পাওয়া গিয়েছে। ফলে ছত্তীসগঢ়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বহিষ্কার করেছেন সনিয়া গাঁধী। দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে অমিতকেও।
হালফিলে স্টিং অপারেশনের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকেও। তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি। ২০০২ সালের গুজরাতে সংঘর্ষের নেপথ্যে বজরং দলের বাবু বজরঙ্গী জড়িত থাকা নিয়ে একটি স্টিং অপারেশন হঠাৎই প্রকাশ পাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে। গোপন ক্যামেরায় বজরঙ্গীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ২০০২ সালের হত্যায় তিনি ‘গর্ব’ অনুভব করছেন। নানাবতী কমিশনের তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়েও রাতারাতি প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল তখন। যার আঁচ সরাসরি আছড়ে পড়েছিল মোদীর উপরে। কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে মোদী বলেছিলেন, গুজরাত ও বিজেপি-বিরোধী শক্তি ভোটের আগে এই প্রসঙ্গকে হাতিয়ার করে টানা এক সপ্তাহ ধরে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু গুজরাতের মানুষ ফের বিজেপিকেই জিতিয়ে এনেছে।
প্রশ্ন হল, গোপন ক্যামেরায় আজ যা ফাঁস হল, তা নিয়েও কি মমতা একই পথে হাঁটবেন? ভোটে যদি তিনি এ বারেও জিতে আসেন, তা হলে কি ধুয়েমুছে যাবে যাবতীয় অভিযোগ? নাকি ভোট সামনে বলেই বিরোধীরা আরও চেপে ধরবে?
সংসদ যেমন সাক্ষী ছিল বড় বড় দু’টি ঘটনার। একটি ঘটনায় কিছু বিজেপি সাংসদ সরাসরি টাকা ভর্তি ব্যাগ লোকসভার ভিতরে টেবিলে এনে ফেলেছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন, সমাজবাদী পার্টির তৎকালীন নেতা অমর সিংহের সহযোগী ঘুষ দিয়েছেন ইউপিএ সরকারের পরমাণু চুক্তির পক্ষে ভোট দিতে। আর একটি ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে দলমত নির্বিশেষে ১১ জন সাংসদকে সংসদে প্রশ্ন করার জন্য টাকা নিতে দেখা যায়।
দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগ গিয়েছিল সংসদের নীতি কমিটির কাছে। কারণ, বিষয়টি সরাসরি সংসদ ও সাংসদদের সঙ্গে জড়িত। আজকের ঘটনাতেও তৃণমূলের সাংসদরা জড়িত। সিপিএম নেতৃত্ব এ ব্যাপারে নন্দীগ্রামের সিপিআই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। স্টিং অপারেশনে তাঁর দুর্নীতি ধরা পড়ার পর বিধানসভার নীতি কমিটি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। সুপারিশ করে বিধায়ক পদ খারিজের। সংসদে প্রশ্ন ঘুষ কাণ্ডে ১১ জন সাংসদের বিরুদ্ধেও তেমনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি জানাচ্ছেন, যেহেতু তৃণমূলের কিছু সাংসদ ও বিধায়ককে ক্যামেরায় টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, তাই এ নিয়ে তাঁরা সংসদ ও বিধানসভার নীতি কমিটির তদন্ত দাবি করবেন। আইনের গণ্ডিতে থেকে যত দূর এগোনো যায় ততটাই এগোবেন তাঁরা।
তবে স্টিং অপারেশন নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। ফলে এমন অভিযান নিয়ে বিধিনিষেধও নেই তেমন। বাজারে এখন গোপন ক্যামেরা পাওয়া যায় অনায়াসে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি আগে থেকেই ব্যাগে, ক্যামেরায়, চশমায় এমন ক্যামেরা রাখতে শুরু করেছিল। এখন তা ঘরে-ঘরে। আগেও এমন দুর্নীতি হতো না, তা নয়। কিন্তু দেশে ক্যামেরা আর টেলিভিশনের দাপাদাপি শুরু হতেই গোপন ক্যামেরায় কুকীর্তি বন্দি করার চলও বেড়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল তো যে কোনও দুর্নীতি ধরতেই ক্যামেরাকে হাতিয়ার করার ডাক দিয়ে রেখেছেন।
জেসিকা লাল মামলাই হোক বা কুখ্যাত বিএমডব্লিউ মামলার সাক্ষীকে প্রভাবিত করা— সবই ধরা পড়েছে গোপন ক্যামেরায়। প্রায়ই বিভিন্ন হাসপাতাল, বিদ্যালয়ের দুরবস্থা তুলে ধরতে স্টিং-এর ভরসাও অনেক বেড়ে গিয়েছে। বলিউডের ‘কাস্টিং কাউচ’-এর গোপন সত্যও বাদ যায়নি গোপন তদন্তে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এ সব এখন হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে। যার আশঙ্কায় মোদী মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ইদানীং অতিথি অভ্যাগতদের সঙ্গে দেখা করার আগে তাঁদের মোবাইল ফোন ও পেন বাইরে রেখে আসার ফরমান জারি করেছেন।
প্রশ্ন এখন একটাই ‘এক্স ফাইল’-এর ভিডিও কি খাঁটি, না সাজানো?
এর জবাবে বিজেপির এক নেতা বললেন, ‘‘ক্যামেরা নেভার লাইজ! দেখে বুঝতে পারছেন না!’’