প্রচারে শঙ্কর সিংহ। রানাঘাটে। — নিজস্ব চিত্র
তড়বড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে হাঁফাচ্ছে ছেলেটি— ‘‘সাধুগুলো এসে পড়েছে দাদা। হাতে অ্যাত্তো বড় ত্রিশূল, গায়ে সুতোটুকুও নেই, এক্কেবারে ইয়ে...’’
বৈশাখের সকাল।
সদ্য দাড়ি কামিয়ে চায়ের কাপ হাতে বৈঠকখানায় বসেছেন, পুরু কার্পেটে নাগা সাধুদের ধুলো-পায়ের ছাপ পড়ল তখনই— ‘ব্যোম শঙ্কর’!
ইদানীং মনটা কেমন নরম হয়ে গিয়েছে তাঁর। পুরনো ঘর, পুরনো ধার, পুরনো বোলচাল— খুব একটা বদলায়নি। তবু দশ-দশখানা বছর তো কম নয়, পুরনো অভ্যাসের অনেক কিছুই পিছনে ফেলে এসেছেন। না হলে, সাতসকালে তাঁর পরিপাটি ড্রইংরুমে নাগা সাধুদের এমন হুঙ্কার রেয়াত করেন?
ছেলেটি কানের কাছে মুখ নামিয়ে আনছে, ‘‘দ্যাখসেন, দাদা কেমন নরম হইয়া গ্যাসে!’’ চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে তিনি নিজেও বলছেন, ‘‘মনটা দুর্বল হয়ে পড়ছিল বুঝলে, বুক ঠুকে নতুন ইনিংসটা শুরুই
করে দিলাম।’’
চাকদহে জাতীয় সড়ক থেকে দু’কদম গড়িয়ে গেলেই সিংহ বাগান। আমছায়ায় ঢাকা তাঁর পেল্লায় বাড়ি। চাতাল জুড়ে শুকনো পাতার জাজিম। টানটান দাঁড়িয়ে রয়েছে খান তিনেক এসইউভি। ছায়া খুঁজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জটলা করেছেন এক ঝাঁক পুরনো অনুগামী আর পড়শি গাঁ-গঞ্জের দুঃস্থ কয়েকটা মানুষ। অনুগামীদের এক জন ধরিয়ে দিচ্ছেন— ‘‘দাদা কাউকে খালি হাতে ফেরান না। কারও বুকের জেরক্স (পড়ুন এক্স-রে) তো কারও ছেলের স্কুলের মাসমাইনে— এ বাড়িতে এক বার এসে পড়লেই হল!’’
রানাঘাটের হারানো বাইশ গজে নতুন ইনিংস শুরুর আগে তাই সাত সকালের দরবার থেকে হাঁক পাড়ছেন— ‘‘কই, আর কে আছে রে, উপরে পাঠিয়ে দে।’’
রোদ চড়ছে। গাছগাছালির পাতা শুকিয়ে আমসি।
কালো প্যান্টের উপরে জলপাই পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন তিনি। এই ক’বছরে চূর্ণি নদীর কোল বরাবর বেশ খানিকটা ছড়িয়ে গিয়েছে শহরটা। তা ছড়াক, সেতুর মুখে পুরনো চায়ের দোকানটা রয়ে গিয়েছে অবিকল আগের মতো। সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে কমলো চলার গতি— ‘‘কী, ভাল আছ তো? ছেলে এখন কোথায়?’’ ‘‘আজ্ঞে, কৃষ্ণনগরে একটা হোটেলে কাজ পেয়েছে’’— কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে দোকানি।
স্টেশন রোডের ভিড়ে মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছেন পুরনো পরিচিতের— ‘‘এই রোদে ছাতা না নিয়েই বেরিয়ে পড়েছেন?’’ বৃদ্ধ হাসছেন, ‘‘তা তোমারই বা মাথায় ছাতা কোথায়!’’
শহরটার ধুলো-বালি তস্য গলি, হাতের তেলোর মতো তাঁর চেনা। বৈশাখী সকালের প্রচারে অহরহ ঠোক্কর চেনা মুখের সামনে। তা সত্ত্বেও বলছেন ‘নতুন ইনিংস’? চশমার কাচ মুছে তিনি বলছেন, ‘‘ব্রাদার, তা তো বলতে হবেই, মাঝে ক’দিন রেস্ট ডে পড়ে গিয়েছিল না!’’
প্রলম্বিত সেই ‘রেস্ট-ডে’র মাঝে একটাই ছোট ইনিংস— কুপার্স নোটিফায়েডে নির্বাচন। সব তাবড় তৃণমূল নেতা প্রচারে এসেছিলেন। তবু তাঁর ভেল্কিতে ১২টা আসনের ১১টাই কংগ্রেসের ঝুলিতে। ‘‘তবে কী জানো, বিধানসভা ভোটের মেজাজই আলাদা’’, ধরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দশ বছর আগে, যে ‘মেজাজ’ এই রানাঘাটের মাটিতেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফল বেরনোর সেই বিকেলটা এখনও যেন নাছোড় মাছির মতো ভনভন করে তাঁর মাথার মধ্যে— এসডিও অফিস থেকে গুলির মতো ছিটকে এসেছিল খবরটা, ১৮১ ভোটে পরাজিত কংগ্রেস প্রার্থী...।
সে দিন, লাল আবির মেখে হাসতে হাসতে যে ছেলেটি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর দিকে, এ বার তাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে তাঁর দল। সিপিএমের সেই পুরনো মুখগুলো এ বার তাঁরই মিছিলে। প্রচারের ফাঁকে, জলের বোতল থেকে চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিচ্ছে অনায়াস ঘনিষ্ঠতায়। অস্বস্তি হচ্ছে না? তিনি বলছেন, ‘‘রাজনীতির বাঁকগুলো সাঙ্ঘাতিক, জানো? এক-এক বাঁকের আড়ালে কে যে তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, বুঝতেই পারবে না!’’
একুশ বছর আগে, তাঁর হাত ধরে রানাঘাট পুরসভায় পা রেখেছিলেন যে তরুণ, এ বার তাঁর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে খুর ঠুকছেন তিনিই, তৃণমূলের পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়। জোড়াফুলের মিছিল শেষে পার্থ বলছেন, ‘‘অস্বীকার করব না, ওঁকে শ্রদ্ধা করি। বহু দিন ওঁর সঙ্গে ঘর করেছি। অনেক রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষীও থেকেছি।’’
ভেজা রুমালে মুখ মুছে তিনিও বলছেন, ‘‘যাক, বাবু (পার্থসারথির ডাক নাম) অন্তত স্বীকার করেছে শুনে ভাল লাগছে।’’ গুরু-শিষ্যের এই বিচ্ছেদের মাঝে চরের মতো পড়ে রয়েছে দু’বছর আগের এক টুকরো পরিসংখ্যান— লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে পনেরো হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন তাঁর সেই শিষ্য। যা শুনে হাসছেন তিনি, ‘‘এটা অনেকটা চৌবাচ্চার অঙ্কের মতো বুঝলে, মিলেও মেলে না!’’
কেন মিলবে না?
বীরনগর স্টেশনে দাঁড়িয়ে, নদিয়া জেলা তৃণমূলের এক নেতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলছেন, ‘‘ঘোঁটটা বেশ ভালই পেকেছে, বুঝলেন! রানাঘাট ১ আর শান্তিপুর পঞ্চায়েতে দলের অনেকেরই এখন পুরনো ব্যথা জেগে উঠেছে। তলে তলে যোগাযোগ রাখছে ওঁর সঙ্গে।’’ আর বিজেপি? লোকসভা ভোটে তারাও তো কুড়িয়েছিল প্রায় ৩৮ হাজার ভোট! পদ্ম-প্রার্থী অনল বিশ্বাস গলা ঝেড়ে বলছেন, ‘‘জোটের মিছিলে আমাদের অনেককেই হাঁটতে দেখছি বটে, তবে ভোটের দিনে কী হয় দেখুন না!’’
অন্ধকার করে এসেছে।
রাস্তার আলোয় লম্বা একটা ছায়া পড়েছে তাঁর। সিংহ বাগানের বাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তিনি, রানাঘাট (উত্তর-পশ্চিম) কেন্দ্রের জোট প্রার্থী, শঙ্কর সিংহ বলছেন, ‘‘ছায়াটা দেখেছো, এখনও বেশ লম্বা। এটাই ভরসা, ব্রাদার!’’