হাতে-হাত। তাহেরপুরের সভায় অধীর চৌধুরী ও শঙ্কর সিংহ। মঙ্গলবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
শেষ চৈত্রের রোদে প্রায় মরুভূমির আঁচ। আর, ভোট-দুপুরে সেই আঁচেই যেন বরফ গলে জল।
রোদ কি শুধু? না, জোটের আঁচ?
কে না জানে, সাগরে চেনা মানুষ হাতছুট হয়ে যায় আর রাজনীতির ঘোলাজলে হারায় বন্ধুত্ব? তেমনই হারিয়ে গিয়েছিল অধীর চৌধুরী আর শঙ্কর সিংহের দোস্তি। ভোটের নামে, জোটের টানে সেই হারানো বন্ধুত্বই মঙ্গলবার কুড়িয়ে পাওয়া গেল তাহেরপুরের মাঠে।
এত দিনের সব গোসা গলে জল!
রানাঘাট উত্তর পশ্চিমের কংগ্রেস প্রার্থী শঙ্কর মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরকে চেনালেন ‘সম্মানীয় লড়াকু নেতা’ বলে। বললেন, ‘‘ওঁর হাত ধরে শুধু কংগ্রেসই নয়, বাম-কংগ্রেস জোটও দৃঢ় হয়েছে।’’
অধীরও পাল্টা বললেন, ‘‘উনি শুধু সম্মানীয় দাদাই নন, বিপদে-আপদে ওঁর কাছে কত যে সাহায্য পেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু কী তাই? ওঁর মতো দক্ষ জনপ্রতিনিধিও খুব কম দেখেছি।’’
একটা সময় ছিল, যখন শঙ্করকে ‘রানাঘাটের মসিহা’ বলে অভিহিত করতেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর। অহরহ পাল্টা প্রশংসা শোনা যেত শঙ্করের মুখেও। অথচ কংগ্রেসের এই দুই ‘জঙ্গি’ নেতার মাঝেই পাঁচিল উঠে গিয়েছিল বছর কয়েক আগে। ২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটে হারার পরেই দলে শঙ্করের গুরুত্ব কমতে থাকে। অধীর প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পরে সেই ফাটল আরও চওড়া হয়।
নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় শঙ্করকে। তাঁর অনুগামীদেরও জায়গা হয়নি জেলার বিভিন্ন কমিটিতে। সে সময়ে দল ছাড়ারও তোড়জোড় শুরু করেছিলেন তিনি। এমনকী, গত বছর ২১ জুলাই, তৃণমূলের শহিদ দিবসে তাঁর তৃণমূলে চলে যাওয়া প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘মমতার দলে’ শঙ্কর যেতে পারেননি। বরং হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব নিয়ে রাজনীতি থেকেই প্রায় নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন।
কোণঠাসা হয়ে গিয়েও শঙ্কর যে তৃণমূলে যেতে পারেননি, তাতে কিন্তু আশ্চর্যের কিছু নেই।
ইতিহাস বলছে, অধীরকে কংগ্রেসে আনতে যাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল, তাঁর নাম শঙ্কর সিংহ। কংগ্রেসে থাকাকালীন অধীর আর শঙ্করকে এক ‘ব্র্যাকেটে’ রাখতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা
ভোটে অধীর, শঙ্করদের প্রার্থী করার প্রতিবাদে আলিপুর ট্রেজারির সামনে গলায় চাদর পেঁচিয়ে এক বার আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন! তার পাঁচ বছর পরে মহাজোটের সময়ে অবশ্য মমতার পাশে দেখা যেত শঙ্করকে। সেই ছবিও চিরস্থায়ী হয়নি। আবার কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়েও অধীর-শঙ্করের প্রতি তাঁর অপছন্দের কথা কখনও গোপন করেননি মমতা। বরং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের দায়ও ওই দু’জনের উপরেই চাপিয়ে এসেছেন তৃণমূল নেত্রী।
মেলালেন কিন্তু সেই মমতাই।
কেননা, মিলিয়ে দিল জোট। যে জোট না হলে এ রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুক ঠুকে ফের উঠে দাঁড়ানোর হিম্মত হত না কংগ্রেসের। বহরমপুর থেকে রানাঘাটে আসত না প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ।
বসন্তের গোড়ায় বরফ গলার সেই শুরু। আর, চেনা উষ্ণতা ফিরতেই এ দিন শঙ্করের জন্য জনসভা করতে বহরমপুর থেকে নদিয়ায় উড়ে এলেন অধীর। তাহেরপুরে ভরা মাঠে বললেন, ‘‘এখানে যিনি প্রার্থী, তাঁর নাম ছেলেবুড়ো সকলে জানেন। উনি আমার বড় দাদার মতো, অভিভাবক। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি।’’
বরফ শুধু মঞ্চে গলছে না। মাঠে-ঘাটেও গলছে। যে কংগ্রেস কর্মীরা এক সময়ে দলে-দলে তৃণমূলে গিয়ে ভিড়েছিলেন, তাঁরাই এখন ফিরতে শুরু করেছেন। এ দিন তাহেরপুরের সভাতেই কংগ্রেসে ফেরেন শ’দেড়েক তৃণমূল কর্মী। আগের দিনই ধুবুলিয়ায় তৃণমূলের প্রায় তিনশো কর্মী কংগ্রেসে চলে আসেন। কল্যাণীর সুভাষনগরে দল বদলেছেন জনা পঞ্চাশেক। এর আগে নাকাশিপাড়া এবং হরিণঘাটায় ঘটেছে একই ঘটনা। সংখ্যাটা এখনও তেমন বড় না হলেও হাওয়ার বদলটা চোখে পড়ছে সকলেরই।
শঙ্করের বিরুদ্ধে ঘাসফুল চিহ্নে দাঁড়িয়েছেন এক সময়ে তাঁরই ‘ডান হাত’ পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়। আঁচটা মালুম হয় অধীরের খোঁচায়— ‘‘যার হাত ধরে রাজনীতিতে এলি, যার খেয়ে বড় হলি, তার বিরুদ্ধেই কি না প্রার্থী হতে গেলি!’’
মঞ্চে তখন মুচকি হাসছেন শঙ্কর। হাততালিতে ফেটে পড়ছে আঁচে বিবর্ণ ঘাস ওপচানো মাঠ।