পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ দিয়ে এক ব্যক্তিকে বুথ থেকে বের করে দিচ্ছেন পর্যবেক্ষক। কিংশুক আইচের তোলা ছবি।
বুথের পাশে দাঁড়িয়ে খোলা চোখে কোনও গরমিল ধরা পড়বে না। মনে হবে এমন ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন বুঝি আগে কখনও হয়নি এ বঙ্গে। বন্দুক আিচের তোলা ছবি।উঁচিয়ে বুথ আগলে রেখেছেন আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা। বুথের একে একে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন ভোটাররা।
কিন্তু এ কী?
বুথের ভেতর রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল। তিনি আবার এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, যেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কে কাকে ভোট দিচ্ছেন! নির্বিবাদে কাজ করে চলেছেন প্রিসাইডিং অফিসার। যেন সব ঠিকই আছে। তাঁর সম্বিৎ ফিরল ঠিক তখন, যখন অনিয়মের ছবি তুলে রাখতে তাক করা হল সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা। বেলিয়া বুথের প্রিসাইডিং অফিসারে হঠাৎই মনে পড়ে গেল কমিশনের নির্দেশিকার কথা। ‘আপনি সরে যান। বাইরে যান’, প্রায় তেড়ে গেলেন কনস্টেবলের দিকে। ততক্ষণে খানিক হকচকিয়ে গিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ওই কর্মী। বাধ্য হয়েই ভোট-আধিকারিক চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, ক্যামেরা তাক করা হয়েছে, সরে না গিয়ে উপায় নেই।
বুথের বাইরেও যথেষ্ট ‘সচেতন’ শাসকদল। কমিশন নির্ধারিত নির্দিষ্ট দূরত্বে তারা শিবির করেছেন। কিন্তু আশপাশে কোথাও নজরে পড়েনি বিজেপি বা বাম-কংগ্রেসের কোনও শিবির। কার্যত ‘অবাধ’ নির্বাচন! শহরে তবু দু’এক জায়গায় বিরোধী শিবির দেখা গেলেও যেতে পারে কিন্তু গ্রামে একেবারেই নয়। বুথের ভিতরেও দেখা মেলেনি বিরোধী দলের এজেন্টদের। শৌলা, খয়রুল্লাচক — কোথাও কোনও ব্যতিক্রম নেই।
তৃণমূলের শৌলা বুথ সভাপতি মধুসূদন সিংহের দাবি সেই চিরন্তন, “এখানে সিপিএমের লোকই নেই। ওরা এজেন্ট না দিতেই পারেনি। আমরা কী করব!” মেদিনীপুর কেন্দ্রের সিপিআই প্রার্থী সন্তোষ রাণার মন্তব্য, “আগের রাতে যে ভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাতে শিবির করার ঝুঁকি নিতে পারিনি। ২০-২২টি বুথে এজেন্টদেরও বসতে দেওয়া হয়নি। এটাকে যদি অবাধ নির্বাচন বলা যায়, তাহলে বলব অবাধ!’’ শ্লেষ ঝরে পড়ে তাঁর গলায়, ‘‘নির্বাচনের আগে কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর যে ‘হাঁকডাক’ শোনা গিয়েছিল, নির্বাচনের দিন তা দেখতে পেলেন না মানুষ।’’
গোটা মেদিনীপুর কেন্দ্রের এ প্রান্ত-সে প্রান্ত ঘুরেও দেখা মিলল না পুলিশি টহলের। সকালে যখন বেরিয়েছিলাম, কুতুরিয়ার কাছে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। ৪ ঘন্টা পরে যখন ওই পথে ফিরছি তখনও গাড়িটি সেখানেই দাঁড়িয়ে। যে গাড়িটির দেখা মিলেছিল গোদাপিয়াশাল বাজারে গাছের ছায়ায়, সেও এক পা নড়েনি। সেই সুযোগেই এ দিনও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছে তৃণমূল।
পাড়ায় গিয়ে বলছেন, ‘দাদা, বৌদি এখনও ভোট দিতে গেল না কেন?’
ইতিবাচক বা নেতিবাচক উত্তর যেমনই আসুক, ঝটিতে মিলেছে আশ্বাস, ‘‘ঠিক আছে, এখুনি গাড়ি আসছে। পাড়ার আরও অনেককে তুলতে হবে। এখন লম্বা লাইন। লাইন কমলেই গাড়ি এসে যাবে।’’ লাইন ফাঁকা হতে সত্যিই এসেছে মোটরবাইক বা চারচাকা। একেবারে বুথের কাছে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন পাড়ার তৃণমূল কর্মীরা। বোতাম টেপার আগে পর্যন্ত বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘‘দু’নম্বর বোতামটা কিন্তু, দু’নম্বর’’। ওটাতেই মৃগেন্দ্রনাথ মাইতি, জোড়া ফুল।
আর কট্টর সিপিএম সমর্থকদের শাসক দলের ‘যুবক’রা বলছেন, ‘ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই।”