কাটোয়ায় অধীর চৌধুরী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
উলট-পূরণ হয়ে গিয়েছে এক বছরের মধ্যেই। গত বছর এপ্রিলে কাটোয়া পুরভোটে যিনি ছিলেন সেনাপতি, এ বার তিনিই বিরোধী শিবিরের প্রার্থী। কাটোয়ায় সভা করতে এসে তাই রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ‘মীরজাফর’ আখ্যা দিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর দাবি, ‘‘আদর্শ বিসর্জন দিয়েছেন রবিবাবু। কাটোয়ার মানুষ ঠিক এর জবাব দেবেন।”
শনিবার বিকেলে কাটোয়ার নজরুল মঞ্চে কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামা মজুমদারের সমর্থনে সভা করতে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন অধীরবাবু। অন্য জায়গায় যাওয়ার তাড়া থাকায় তিনি সভা শুরু করে দেন। গোড়া থেকেই তাঁদের দলের এক সময়ের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথবাবুকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন অধীরবাবু।
কংগ্রেসের অন্দরের খবর, গোষ্ঠী-রাজনীতিতে এক সময় অধীরবাবুর পাশে ছিলেন রবিবাবু। বহরমপুর লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর পর থেকে অধীরবাবুর সঙ্গে রবিবাবুর সম্পর্ক ভাল ছিল। কেতুগ্রামের একটি খুনের ঘটনার অভিযোগে তাঁদের দু’জনের নাম ছিল। এক সঙ্গে দিনের পর দিন কাটোয়া আদালতে হাজিরও দিয়েছিলেন তাঁরা। পরে দু’জনেই সেই মামলায় খালাস পেয়ে যান।
গত বছর পুরভোটের দিন ‘ভূতের উপদ্রব’ দেখেছিল কাটোয়া শহর। ভয়ে শহরের মানুষ ঘর ছেড়ে বেরোননি। বুথের লাইনে দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। সেই ঘটনার পরে অধীরবাবুর কাটোয়ায় এসে কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, আক্রান্তদের দেখতে বাড়িতেও যান। পুরভোটের ফল বেরোতে দেখা যায়, কাটোয়ার ২০টি আসনের মধ্যে অর্ধেক কংগ্রেসের দখলে রয়েছে। বাকি অর্ধেকে জিতেছে তৃণমূল। তৎকালীন কংগ্রেস নেতা রবীন্দ্রনাথবাবু টসে না গিয়ে বিরোধী আসনে বসার সিদ্ধান্ত নেন। তার পর থেকেই জল্পনা শুরু হয়, তিনি ও তাঁর দলবল তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন।
গত বছর ২৯ মে রবীন্দ্রনাথবাবু কংগ্রেস ছেড়ে শেষমেশ তৃণমূলে যোগ দেন। এ বার তৃণমূলের টিকিটেই কাটোয়ায় প্রার্থী তিনি। এ দিন অধীরবাবু বলেন, “রবিবাবু কংগ্রেসের মানুষের কাছে আদর্শ ছিলেন। বিধানসভায় গেলে তাঁকে সম্মানিত করা হত। কাটোয়ায় কংগ্রেস ও রবিদা সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন।’’ এর পরেই তাঁর অভিযোগ, ‘‘এখন দেখেছেন, কংগ্রেস করে বাজার খুলবে না, রোজগারপাতি হবে না। তাই বুদ্ধিমানের মতো রবিবাবু তৃণমূলে চলে গেলেন!”
১৯৯৫ সালে বামেদের ধাক্কা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কাটোয়া পুরসভা দখল করে কংগ্রেস। ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হন। পরপর চার বার কাটোয়া থেকে তিনি কংগ্রেসের বিধায়ক হয়েছেন। সে কারণেই এ দিন অধীরবাবু বলেন, “কাটোয়ার মানুষ রবিবাবুকে নেতা বানিয়েছিলেন। দিদি জানতেন, রবিবাবুর মনের ইচ্ছা। সে জন্য তাঁর মুখের সামনে গাজর ঝুলিয়ে দিয়ে মন্ত্রী করবে বলে টেনে নিলেন। ফলে, তিনি নেতা থেকে দিদির দলে ক্রীতদাস হয়ে গেলেন। কাটোয়াতেও মীরজাফরের জন্ম হয়ে গেল!” সভায় হাজির ছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক তথা জেলা কমিটির সদস্য অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরা।
রবীন্দ্রনাথবাবুর প্রতিক্রিয়া, “সিপিএমের বিরোধিতা, কাটোয়ার উন্নয়ন ও শান্তির পরিবেশের জন্য আমি তৃণমূলে যোগ দিয়েছি। কর্মী-সমর্থকদের মত নিয়েই দল বদলেছি।”
এ দিন বিকেলে পূর্বস্থলীর সমুদ্রগড়ে নিমতলা মাঠে সভা করেন অধীর। সেখানে ভিড় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বলেন, ‘‘বৈশাখের রোদে তৃণমূল শুকিয়ে গিয়েছে। এই মাঠে হাজারো মানুষের জমায়েত তার প্রমাণ।’’ তিনি ভোট লুঠের চেষ্টা হলে কর্মীদের রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন বাম-কংগ্রেস জোটের নেতা-কর্মীদের। সভায় ছিলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঞ্জু কর, প্রাক্তন সাংসদ সাইদুল হক প্রমুখ। এই সভায় কংগ্রেসে যোগ দেন বর্ধমানের তৃণমূল নেতা খন্দেকার মহম্মদ হোসেন আলি।
পূর্বস্থলী দক্ষিণের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক রতন দাসের দাবি, ‘‘এ দিন এলাকার ১১টি পঞ্চায়েত থেকেই মানুষ এসেছিলেন।’’ এই ১১টি পঞ্চায়েতেই ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। বিরোধীদের সভায় এমন জমায়েত চিন্তায় ফেলেছে শাসকদলকেও। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এত লোক হবে ভাবিনি।’’