শান্তির আড়ালে হুমকি আর ভেটের ভোট

জঙ্গলমহলে ভোটের আগের দিন চাঁদিফাটা রোদ মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম। গন্তব্য ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বেলপাহাড়ির কিছু গ্রাম। এলাকাটা বিনপুর বিধানসভায় পড়ে, যেখানে ২০১১-র ঝড়েও জয় পেয়েছিল সিপিএম। এ বার গ্রামের পর গ্রাম শুধু তৃণমূলের পতাকা। এমনকী চাষজমিও ঘাসফুলের দখলে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

বিনপুর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৫
Share:

ভোটের দিন মাংস-ভাত, মুড়ি বিলির খবরগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ৫ এপ্রিলের আনন্দবাজার পত্রিকায়। বিনপুর বিধানসভার ভীমার্জুন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এমন ফাঁকা বুথেও বেলা সাড়ে ১২টার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল ৭৫ শতাংশ ভোট। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

জঙ্গলমহলে ভোটের আগের দিন চাঁদিফাটা রোদ মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম। গন্তব্য ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বেলপাহাড়ির কিছু গ্রাম। এলাকাটা বিনপুর বিধানসভায় পড়ে, যেখানে ২০১১-র ঝড়েও জয় পেয়েছিল সিপিএম। এ বার গ্রামের পর গ্রাম শুধু তৃণমূলের পতাকা। এমনকী চাষজমিও ঘাসফুলের দখলে।

Advertisement

মাওবাদী পর্বে এই এলাকায় ভোট বয়কট দেখেছি। খুনোখুনি-নাশকতাও দেখেছি বহু। এ বার সে সব নেই। কিন্তু ‘শান্তিকল্যাণে’র মাঝে কী যেন একটা খচখচ করছিল।

চাকুলিয়া থানার ডাকাই গ্রামে মকর সিংহ, কাদুনাথ সিংহদের সঙ্গে কথা বলে অস্বস্তিটা বেড়ে গেল। ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁরা বলছিলেন, ‘‘এখানে তো ভোট হয়ে গিয়েছে।’’ মানেটা প্রথমে ঠাহর করতে পারিনি। পরে গ্রামবাসীর সঙ্গে আরও কথা বলে বুঝলাম, মাওবাদীদের গা-ঘেঁষা লোকজনের বেশির ভাগ এখন তৃণমূলে নাম লিখিয়েছে। অনেক ছেলে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি পেয়েছে। ভোট করানোর দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়েছে তারাই।

Advertisement

কী ভাবে?

শিমুলপালের এক প্রবীণ বাসিন্দা জানিয়েছিলেন, গ্রামবাসীদের দেদার মাংস-ভাত-হাঁড়িয়া খাওয়ানো হচ্ছে। সঙ্গে বিলি হচ্ছে টাকা। দেখে-শুনে বুঝে গিয়েছিলাম, কমিশন যতই কড়াকড়ির কথা বলুক, ভোটের দিন অন্য ছবিই দেখা যাবে। ভুল যে ভাবিনি, বুঝলাম ৪ তারিখ! ভোটের দিন!

ভীমার্জুন প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে গিয়ে দেখি বাইরেটা খাঁ-খাঁ। কাঠফাটা রোদে কোথাও জনমনিষ্যি নেই। অথচ দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই সেখানে ৩৬০টি অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ ভোট পড়ে গিয়েছে। লালজল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথেও দুপুরের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট পড়ে। দিনের শেষে ওই বুথে ভোট পড়েছে একশো শতাংশ!

পঞ্চায়েত-বিধানসভা-লোকসভা— জঙ্গলমহলে ভোট দেখার অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়। কিন্তু এমন ভুতুড়ে ভোট কোনও দিন দেখিনি। যেমন দেখিনি সিআরপি জওয়ানদের দুর্ব্যবহার। জঙ্গলমহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আনাগোনা তো সেই মাওবাদী আমল থেকেই। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি দেখলে ভিন্‌ রাজ্যের জওয়ানরা খোশগল্প করেন, সুখ-দুঃখের কথা বলেন, এমনটাতেই অভ্যস্ত ছিলাম। এ বার বাহিনী নিয়ে গোড়া থেকেই নালিশ জানাচ্ছিলেন বিরোধীরা। বলছিলেন, জওয়ানরা প্রত্যন্ত এলাকায় যাচ্ছে না। ভোটের আগের দিন কাঁকড়াঝোরে গিয়ে দেখেছিলাম টিলার উপর সিআরপি ক্যাম্প। অথচ মোটরবাইকে টহল

দিচ্ছে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ। ছবি তুলতে গেলে আমার সহকর্মী আলোকচিত্রী দেবরাজ ঘোষকে রীতিমতো গালিগালাজ করা হল।

ভোটের দিন ফের দেখলাম সিআরপি-র রণমূর্তি। ভাগাবাঁধ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের বাইরে থাকা জওয়ানরা নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র দেখেও বললেন, ‘ইয়ে সব বকওয়াস হ্যায়। হঠো ইঁহাসে।’ কেন? জবাব মেলেনি। কাছেই তৃণমূলের জমায়েত থেকে মন্তব্য উড়ে এল, ‘‘একদম ঢুকতে দেবেন না স্যার।”

বেলপাহাড়ি এসসি হাইস্কুলেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা বলে দিলেন, “পারমিশন নেহি হ্যায়।” একরাশ বিরক্তি আর অপমান হজম করে পৌঁছলাম শিমুলপাল অঞ্চলের ধোবাকাচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে। সেখানে স্থানীয় তৃণমূল নেতা পরেশ হেমব্রম বুথ চত্বরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। জওয়ানরা ঠুঁটো হয়ে দাঁড়িয়ে। পরেশবাবু বললেন, ‘‘আমিও তো ভোটার। তাই আছি।’’ ভোট দেওয়ার পরেও কেন দাঁড়িয়ে আছেন? উত্তর এল, “কে, কী ভাবে আসছেন, যাচ্ছেন সে সব না দেখলে চলবে কী করে!” ঘাড়ধাক্কা খেয়ে তত ক্ষণে বেশ কয়েকটি বুথ থেকে সরে পড়েছেন বিরোধী এজেন্টরা।

দেদার মুড়ি বিলোনোর দৃশ্য দেখেও এ বার অবাক হয়েছি খুব। বিনপুর, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম— পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় প্রতিটি বিধানসভা এলাকাতেই বিভিন্ন বুথে ৫০-৬০ মিটারের মধ্যে তৃণমূলের ক্যাম্প থেকে ভোটারদের দেদার মুড়ির প্যাকেট বিলি করা হয়েছে। বেলপাহাড়ির বুড়িঝোর প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথের কাছেই বিষ্ণুপদ সিংহের মাটির বাড়ি। ভিতরে খাটিয়া পেতে ভোটার আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিলেন কয়েক জন মহিলা। আপনারা কি তৃণমূল করেন? শুশনিজবি গ্রামের দামিনী সিংহের জবাব, “হ্যাঁ ওই আর কী। সব ভোটারকে নাস্তা বিলি করছি।”

পূর্ণাপানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এক বৃদ্ধার হাতে টাকা গুঁজে দিতে দেখলাম দুই যুবককে। কড়কড়ে একশো টাকার নোট পেয়ে বৃদ্ধার মুখে হাসির ঝিলিক— ‘হ তুদেরই ভোট দিছি’। আপনারা কি তৃণমূল করেন? এ বারও জবাব, “ওই আর কী।” টাকা কীসের? এ বার জবাব তিরিক্ষি, “মানুষের সেবা করলেও দোষ?”

তৃণমূলের এই ‘সেবা’ যারা নেয়নি, তাদের জল বন্ধ। বুধবার সকালে খবর এল, ভোট মিটতেই গোপীবল্লভপুর বিধানসভার ডালকাটি গ্রামের লোধাপাড়ায় নলকূপ শিকল জড়িয়ে তালা মেরে বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমূলের লোকজন। কাঁটা-ঝোপ এনে কলতলা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ‘ভোট যখন সিপিএম-বিজেপিকে দিয়েছ, তখন খাওয়ার জল ওদেরই দিতে বলো’ গোছের কথাও শুনতে হয়েছে লোধাপাড়ার বাসিন্দাদের। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে নলকূপের শিকল খোলা হয়।

ভোট বয়কটের জঙ্গলমহলে গণতন্ত্রে অনাস্থা দেখেছি। তবে ভোট-শেষে এমন শিকলে বাঁধা গণতন্ত্র অচেনা ছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement