কত ভোট এল, নদী তো গিলছেই

নৌকার গলুইটা নদীর পাড় ছুঁতেই লাফ দিয়ে নামলেন বছর বত্রিশের যুবক নকুলাল মাহাতো। তার পর একে একে নামালেন নিজের সাইকেল আর খান পাঁচেক বড় ব্যাগ।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

কল্যাণী শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০০
Share:

এ ভাবেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে নদী। — নিজস্ব চিত্র

নৌকার গলুইটা নদীর পাড় ছুঁতেই লাফ দিয়ে নামলেন বছর বত্রিশের যুবক নকুলাল মাহাতো। তার পর একে একে নামালেন নিজের সাইকেল আর খান পাঁচেক বড় ব্যাগ।

Advertisement

ব্যাগগুলো সাইকেলে বেঁধে চলেই যাচ্ছিলেন, প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন নকুলাল। — ‘‘একটা জেটি কিংবা নিদেনপক্ষে একটা পাটাতন থাকলে ভাল হত না?’’

—‘‘জেটির কথা বলছেন!’’ আঙুল তুলে একটা জায়গার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘দু’বছর আগেও নৌকা থেকে ওই, ওই জায়গাটায় নামতাম। সেটা এখন নদীর গর্ভে। আর ওই যে দেখছেন নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, আরও পাঁচ বছর আগে ওখানে আমাদের জমি ছিল। সে জমিখান যাওয়ার পর এখন আমি চাষি থেকে মুদি দোকানি।’’

Advertisement

নকুলাল ভাঙন কাহিনির একজন চরিত্র মাত্র। কল্যাণী লাগোয়া গঙ্গা তীরবর্তী চর জনপদগুলিতে নকুলালের মতো এমন আরও অনেকের হাহাকার ভেসে আসে নদীর হাওয়ায়। সে হাওয়ায় ধাক্কা দিয়ে যায় ভোট। ভোট আসে আবার নির্ঘণ্ট মেনে সাঙ্গও হয়। গঙ্গা ভেঙে চলে তার নিজস্ব নিয়মে। চর যাত্রাসিদ্ধি, চর যদুবাটি, চর সরাটি, চর মধুপুরের কাহিনির কোনও বদল হয় না। চরের বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘ভোটের সময় অবিশ্যি আশ্বাস মেলে। কিন্তু ভোট ফুরোতেই সব ফক্কা।’’ এ সব অবশ্য গা সওয়া হয়ে গিয়েছে নকুলালদের।

আপনারা কিছু বলেন না? প্রতিবাদ করেন না? ভেন্ডি ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করছিলেন বৃদ্ধ সোমলাল মাহাতো। চর যদুবাটির বাসিন্দা তিনি। প্রশ্নটা শুনে এত ক্ষণে মুখ তুলে চাইলেন বৃদ্ধ। বললেন, ‘‘এই যে জমির আগাছা পরিষ্কার করছি, এটা খুব সহজ। কিন্তু, আমাদের সমাজে যে আগাছা রয়েছে, তা কি আর এ ভাবে তুলে ফেলা যাবে?’’ খানিকটা হেসে আবার বললেন, ‘‘বুঝলেন না তো এ বুড়োর কথা? আসলে ভুত যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই এখন পার্টির নমক খায়। তাই, তাদের হাতে রাখলেই কাজ হয়ে যায়। আমাদের কিছু লোককে ওরা কিনে নিয়েছে। তাদের দিয়েই ওরা সব ম্যানেজ করে রাখে। তাতে নদীর পাড় ভাঙল কি না, আমাদের বাড়ি তলিয়ে গেল কি না, আমরা বাঁচলাম না মরলাম, সে হদিশ ওরা রাখে না।’’

এক সময় বিহারের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে গঙ্গার তীরবর্তী এই সব এলাকায় এসে ঘর বেঁধেছিল কয়েকশো পরিবার। গঙ্গা তখন হুগলীর দিকে ভাঙছে। আর এ দিকে গড়ছে। দাবিহীন সে সব জমিতে ঘর তুলেছিলেন ওঁরা। উর্বর মাটিতে শুরু করেন চাষাবাদ। কিন্তু, গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরুতেই এ পারে ভাঙন শুরু হয়। হুগলীর ও পারের নদীর পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তার পর থেকে নদী এ পারে বিঘের পর বিঘে জমি গিলতে শুরু করেছে।

অন্যান্য চর গুলির বাসিন্দারা অনেক আগেই ভোটাধিকার পেলেও চর যাত্রাসিদ্ধির মানুষরা ভোটাধিকার পেয়েছেন এই সে দিন, ২০০৯ সালে। ফলে তাঁদের প্রতিবাদে কর্ণপাত না করাটাই স্বাভাবিক রাজনীতির কারবারিদের। বহু দিন পর্যন্ত তাঁদের দাবি গুরুত্ব পায়নি। অন্যান্য চরের বাসিন্দাদের দাবিও কানে তোলেনি কেউ। ফলে পাড় বাঁধানোর কোনও চেষ্টাই হয়নি। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গত কয়েক বছরে কয়েকশো বিঘে জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। বহু পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। জমি-বাড়ি হারিয়ে বেশ কিছু পরিবার বাস উঠিয়ে চলে গিয়েছে অন্যত্র।

এলাকার বাসিন্দা মিঠুন মাহাতো জানালেন, প্রতি ভোটের সময় নেতারা প্রচারে এসে নানা ধরনের আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় বলা হয়েছিল, এক বছরের মধ্যে পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু হবে। কিন্তু ভোট পার হতেই নেতারা এ মুখো হননি। ফলে ভোট এলেই যে এমন আশ্বাস শুনতে হবে বুঝে গিয়েছেন চরের বাসিন্দারা।

কল্যাণীর এসডিও স্বপন কুণ্ডু বলছেন, ‘‘ভাঙন ঠেকানোর জন্য কয়েকটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেই সব প্রকল্পের জন্য জেলাতে রিপোর্টও পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি প্রকল্পে চর এলাকায় পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু হওয়ার কথা। ভোট পার হলে সেচ দফতর থেকে বিস্তারিত জানতে পারব।’’

‘‘তাই বুঝি...!’’ হেসে ফেললেন বৃদ্ধ চাষি সোমলাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement