ভোটের মুখে নারদ-কাণ্ড যে কী প্রবল চাপ হয়ে হাজির হয়েছে তাঁর সামনে, ফের তা বুঝিয়ে দিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
নারদ নিউজ পোর্টালের গোপন ক্যামেরার ছবিতে ঘুষ নিতে দেখা দিয়েছে তৃণমূলের ডজনখানেক নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ককে। বিষয়টি এখন বিচারাধীন। কিন্তু ভোট-রাজনীতিতে তা নিয়ে আলোড়ন যে থামছে না এবং জনমানসে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৃণমূলের ভাবমূর্তি, তার আরও স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে এবিপি নিউজ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ সমীক্ষায়। যে সমীক্ষায় বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ কলকাতা শহরকে ৫টি এলাকায় ভাগ করে ১০১৯ জনের মধ্যে মতামত যাচাই করা হয়েছে। এবং তাঁদের সিংহ ভাগই ঘুষ-কাণ্ডে তৃণমূল নেত্রী ও তাঁর দলের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে বলেই রায় দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতি আন্দাজ করেই এখন মরিয়া হয়ে নিজের ‘সততা’র ভাবমূর্তি বাজি রাখছেন মমতা। যে কারণে শুক্রবার ফুলবাড়ি-ডাবগ্রাম কেন্দ্রে প্রচারে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী সরাসরিই বলেছেন, ‘‘গৌতম দেব, খগেশ্বর রায়, রবীন্দ্রনাথ ঘোষরা নয়। মনে রাখবেন, ২৯৪টি কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী!’’ এমন কথা মমতা ২০১১ সালের নির্বাচনের আগেও বলতেন। কিন্তু এখন পাঁচ বছর সরকারে কাটিয়ে এবং সারদা, নারদ-সহ একের পর এক কেলেঙ্কারির পরে মমতার এমন কথা বলার অর্থ, বাকি দলের চেয়ে তিনি নিজের ভাবমূর্তির জোরেই ভোট বৈতরণী পেরোতে চাইছেন।
যদিও সেই ভাবমূর্তিতে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে জনমত সমীক্ষা। ঘুষ-কাণ্ডের উপরে করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মমতার নিজের ভাবমূর্তিও ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করছেন ৫৬% মানুষ। ষ়়ড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করে মমতা অভিযুক্ত নেতাদের বাঁচাতে চাইছেন বলে মনে করছেন ৫১% মানুষ। অভিযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচনের লড়াই থেকে মমতারই সরিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন ৬১%। সারদার চেয়েও ঘুষ-কাণ্ডে ‘সততার প্রতীকে’র ভাবমূর্তি বেশি কলঙ্কিত হয়েছে, সমীক্ষায় এমন কথাও জানিয়েছেন বেশির ভাগ মতদাতা। আর ঘুষ-কাণ্ডকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা ফায়দা তুলতে পারবেন বলে মনে করছেন ৪৪%। যদিও একই সংখ্যক মানুষ মনে করেন বিরোধীরা ফায়দা তুলতে পারবেন না!
এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ সমীক্ষা
বিরোধীরা অবশ্য দাবি করছে, জনমত সমীক্ষায় যা উঠে এসেছে, ভোট হতে হতে সেই মতই আরও স্পষ্ট হবে। সমীক্ষার দৃষ্টান্ত দিয়েই বিরোধী নেতাদের আরও দাবি, এখন আর ‘আমাকে দেখে ভোট দিন’ বলে আর্জি জানিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না মমতা। সারদা থেকে ঘুষ-কাণ্ড, একের পর এক ঘটনাতেই দলের অভিযুক্তদের আড়াল করতে এগিয়ে এসেছেন তৃণমূল নেত্রী। তাই অন্যায়ে সরাসরি অভিযুক্ত না হলেও ‘প্রশ্রয়’ দেওয়ার অভিযোগে জনমানসে তাঁর প্রভাব কমবেই। যে দাবি আবার মানতে নারাজ শাসক দলের নেতৃত্ব।
মমতা বরং বিরোধীদের ঘাড়ে কুৎসার দায়ই চাপাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গের সভাতেই এ দিন তাঁর মন্তব্য, ‘‘উন্নয়নে, প্রগতিতে, সংহতিতে লড়তে না পেরে কাজ একটাই— কুৎসা জোট! কিছু লোকের আছে কাজ নেই। আপনারা কৈকেয়ী, মন্থরা, নাককাটা শূর্পণখার কথা শুনেছেন। এরা কুটুস কুটুস করে!’’ মমতা যেমন বিরোধীদের তোপ দেগেছেন, তেমনই এ দিন কলকাতার পথে নেমে একই কাজ করেছেন তাঁর দলের নেতারা। ঘুষ-কাণ্ডে অভিযুক্তদের শাস্তি চেয়ে ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার মিছিল করেছিল বামেরা। তারই পাল্টা এ দিন শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল ছিল শাসক দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের। মিছিলের শেষে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সরাসরি না-বললেও ঘুষ-কাণ্ডের ভিডিওকে ঘুরিয়ে বিরোধীদের ‘কুৎসা’ এবং ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন। বামেদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু নারদ সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়া তো দূর অস্ত, ওই শব্দটিও উচ্চারণ করেননি!
কিন্তু শাসক দলের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে নারদ নিউজের সম্পাদক-সিইও ম্যাথু স্যামুয়েলের এ দিন এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকার। যেখানে স্যামুয়েল দাবি করেছেন, স্টিং অপারেশন শুরু করার আগে তৃণমূল বিধায়ক ইকবাল আহমেদই গোড়ায় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। ইকবাল তাঁর দাদা সুলতানের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন স্যামুয়েলকে। পরে আইপিএস অফিসার সৈয়দ মহম্মদ হুসেন মির্জা তাঁকে মদন মিত্র ও মুকুল রায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইকবাল তাঁকে বাকি নেতাদের কাছে নিয়ে গেলেন কেন? স্যামুয়েল বলেন, ‘‘ইকবাল জানতেন যে, আমি বড় ব্যবসায়ী এবং আমার অনেক টাকা রয়েছে।’’ তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ নিয়ে মুখ খোলেননি। আর ইকবালের মোবাইলে রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
পাশাপাশি বিরোধীরাও শাসকের উপরে চাপ অব্যাহত রেখেছে। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ইস্তফা চেয়ে এ দিন কলকাতা পুরসভার বাইরে বিক্ষোভ দেখান সিপিএমের যুব ও মহিলা শাখার এক দল সমর্থক। মেয়র অবশ্য এ দিন পুরসভাতেই আসেননি। পরে বিক্ষোভের প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘পাগলে কি না বলে....!’’