(বাঁ দিক থেকে) গৌতম দেব, শঙ্কর চক্রবর্তী, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ও উইলসন চম্প্রমারি।
পাঁচ বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। বিশ্বে উষ্ণায়নের মাত্রা থেকে আইপিএলে নিলামের দর। বদলেছে জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির হিসেবও। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনকে হলফ করে সম্পত্তির পরিমাণ জানাতে হয়েছে প্রার্থীদের। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে কমিশন সেই হলফনামা প্রকাশও করে দিয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের হলফনামায় চোখ বুলিয়ে দেখা যাচ্ছে, নানা রূপে সম্পত্তির বহর বেড়েছে। কেউ নতুন গাড়ি কিনেছেন, কারও বা পুরনো বাড়ির বাজারদর বেড়েছে লাফিয়ে। আড়ালে সেই প্রার্থীর অনুগামীদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘আসলে, ওই পুরনো ফ্ল্যাটে নতুন এলইডি ঢুকেছে, স্বয়ংক্রিয় আধুনিক ফ্রিজও। আবার বাতানুকুল যন্ত্রও ঘরের নতুন অতিথি।’’ কেউ কৃষির জন্য জমি কিনেছেন, কারও বা হলফনামায় নতুন এসইউভি-র রেজিস্ট্রেশন নম্বর। অন্য দিকে, কারও আবার নিজের নামে বাড়ি-গাড়ি নতুন কিছু না হলেও, স্ত্রীর নামে সম্পত্তি বেড়েছে। কারও আবার বিমায় বিনিয়োগ বেড়েছে। ভোটের ফলে যাই হোক না কেন, ভোটের আগে সম্পত্তি বৃদ্ধির বহরে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরাই টেক্কা দিয়েছেন অন্যদের। তৃণমূল সূত্রে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, বিধায়কদের কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, কেউ বা সরকারি পদ পেয়েছেন। তাই সরকারি সাম্মানিক, ভাতা, বিভিন্ন বৈঠকে যোগ দেওয়ার ভাতাও মিলেছে। তাই আয় বেড়েছে। সরকারি পদে থাকার সুবাদে অনেক সুযোগ-সুবিধে মেলে অথবা বছর শেষে খরচ পাওয়া যায়, তার ফলে সাংসারের খরচ কমেছে, সেই টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কোনও হলফনামাতেই সম্পত্তির পরিমাণ আয়ের তুলনায় অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে দাবি। তৃণমূলের ওই নেতার দাবি, ‘‘তেমন হলে তো কমিশন-ই ব্যবস্থা নিত।’’
নতুন গাড়ি
উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের বিধায়ক অমল আচার্যের হলফনামায় দেখা মিলল নতুন গাড়ির। ২০১১ সালে অমলবাবু হলফনামায় জানিয়েছিলেন তাঁর নামে দু’টি গাড়ি রয়েছে যেগুলির মোট দাম প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। এ বারের হলফনামায় অমলবাবু জানিয়েছেন, তাঁর নামে থাকা গাড়ির সংখ্যা তিনটি। মোট দাম ২৯ লক্ষের কিছু বেশি। তবে অমলবাবুর স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে একটি ছোট গাড়ি বাদ পড়েছে। ২০১১ সালে অমলবাবুর স্ত্রীর সম্পত্তিতে ছিল দু’টি গাড়ি। মোট দাম প্রায় ৮ লক্ষ। এ বারে একটি গাড়ি বাদ পড়েছে। ফালাকাটার বিধায়ক অনিল অধিকারী বছর তিনেক আগে একটি নতুন এসইউভি কিনেছেন। হলফনামায় তিনি জানিয়েছেন, এসইউভির দাম পড়েছে প্রায় ৬ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা।
বেড়েছে স্থাবর-অস্থাবর
মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর সম্পত্তির পরিমাণ গত পাঁচ বছরে বেড়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর নগদ টাকা-সহ সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও সোনা বাবদ তাঁর সম্পত্তি হিসেব দেওয়া হয়েছিল ২ লক্ষ ৮১ হাজার। আর কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট এবং মালদহে একটি বাড়ি ও বামনগোলায় চার বিঘে জমির দাম দেওয়া হয়েছিল ৫ লক্ষ ৮৫ হাজার। কলকাতার ফ্ল্যাটটি তিন জন মিলে কিনেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর সোনা এবং ব্যাঙ্কে সম্পত্তির হিসেব দেওয়া হয়েছিল ৪ লক্ষ ৪১ হাজার ৮৮০ টাকা। কৃষ্ণেন্দুবাবুর ছেলেমেয়ের সম্পত্তির দেওয়া হয়েছিল ২ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। এ বারে দাখিল করা হলফনামায় তিনি ৬৮ লক্ষ ৬২ হাজার টাকার সম্পত্তির হিসেব দিয়েছেন। স্ত্রীর সম্পত্তি ১৮ লক্ষ ৩৪ হাজার। তিন ছেলেমেয়ের নামে ব্যাঙ্কে রয়েছে মোট ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার। কলকাতার ফ্ল্যাট, বামনগোলার জমি ও বাড়ির হিসেব এ বারেও দেওয়া হয়েছে। সেগুলির বর্তমান বাজারদর দেওয়া হয়েছে ৩০ লক্ষ ৫৩ হাজার ২০ টাকা। তিনটি ছোট গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। আর বাকি টাকা ব্যাঙ্ক এবং বিমা সংস্থায় টাকা রয়েছে। ইটাহারের বিধায়ক অমলবাবুর ব্যাঙ্কে জমানো প্রায় ১০ হাজার টাকা পাঁচ বছর বাদে এ বারের হলফনামায় সাড়ে ন’লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সিনেমা হল, মার্কেট কমপ্লেক্স তো আগে থেকেই ছিল নতুন একটি বাণিজ্যিক ভবনও রয়েছে হলফনামায়। সব মিলিয়ে মূল্য বেড়েছে ১০ লক্ষ টাকার। বেড়েছে অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণও। ২০১১ সালে অস্থাবর সম্পত্তি প্রায় ৮ লক্ষের কাছাকাছি ছিল, অমলবাবু এবারের হলফনামায় জানিয়েছেন, তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩৮ লক্ষ ৯০ হাজার। স্থাবর সম্পত্তির পরিমাঁ বেড়েছে প্রায় ১৬ লক্ষ।
জমি, বাড়ি, নগদ
ফালাকাটার তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বিধায়ক অনিল অধিকারীর হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কমে গিয়েছে। পাঁচ বছর আগে তাঁর হাতে নগদত ১৫ হাজার টাকা থাকলেও, এবারের হলফনামায় তাঁর নগদের পরিমাণ মাত্র ৫ হাজার টাকা। তবে বেড়েছে অনিলবাবুর জমি এবং বাড়ির মূল্য। ২০১১ সালের হলফনামায় অমিলবাবু জানিয়েছিলেন চাষের জমি এবং বাড়ি মিলিয়ে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ১২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর বাদে এবারের হলফনামায় অনিলবাবু লিখেছেন তাঁর ২.৪১ একর চাষের জমি রয়েছে, যার বর্তমান বাজারদর ৫০ লক্ষ টাকা। দশ হাজার ন’শো বর্গফুট জমিতে বাড়িও রয়েছে তারও বাজার দর প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা। সে হিসেবে জমি এবং বাড়িতে অনিলবাবুর সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৮৭ লক্ষ টাকার।
ব্যাঙ্ক, বিমা, লগ্নি
কালচিনির বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারি এ বারেও প্রার্থী। ২০১১ সালে উইলসনের হলফনামায় ব্যাঙ্কে জমার পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা। এ বারে তাঁর হলফনামায় ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ প্রায় ৬ লক্ষ টাকা। উইলসনের জীবন বিমার অঙ্কও বেড়েছে। ২০১১ সালে দেড় লক্ষ টাকা জীবন বিমা ছিল তাঁর। এ বারের হলফনামায় জীবন বিমার কলমে দুটি বিমার উল্লেখ রয়েছে, মোট মূল্য ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। কৃষি জমিতে বিনিয়োগের পরিমাণও বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা।
স্ত্রী-ধন
ইটাহারের বিধায়ক অমল আচার্যের স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তি গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ২৮ লক্ষ টাকারও বেশি। হলফনামা অনুযায়ী ২০১১ সালে অমলবাবুর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ছিল ১১ লক্ষ ৯৬ হাজার এ বারের হলফনামায় সেই সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকার।
অন্য মন্ত্রীরা
মানিকচকের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র ২০১১ সালে ভোটের সময় সম্পত্তির হিসেব দেখানো হয়েছিল ১২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। তার মধ্যে জমি, বাড়ি, সোনা ও ব্যাঙ্কের আমানতও ছিল। তাঁর পুরাতন মালদহের ছাতিয়ান মোড়ে ০.২৭ একর জমি রয়েছে। সেই জমির এখন বাজার মূল্য ৩ লক্ষ টাকা। আর পুরাপাড়ায় থাকা বাড়ির দাম আট লক্ষ টাকা। সোনা রয়েছে ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার। নগদ ও ব্যাঙ্কে রয়েছে ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। মোট সম্পত্তির পরিমাণ, ১৭ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা। ইসলামপুরের বিধায়ক জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী ২০১১ সালের হলফনামায় জানিয়েছিলেন, তাঁর আয় তিন হাজার টাকা। এ বারের হলফনামায় তাঁর আয় প্রায় ৩ লক্ষ টাকার কাছাকাঠি দেখানো হয়েছে। পূর্তমন্ত্রী তথা বালুরঘাটের তৃণমূল প্রার্থী শঙ্কর চক্রবর্তীর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। ২০১১ সালের হলফনামা অনুযায়ী, শঙ্করবাবু ও স্ত্রীর মোট অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ১০ লক্ষ ৯৩ হাজার ৭১০ টাকা। ২০১৬-তে তা বেড়ে হয়েছে ৬৮ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩৫৮। ২০১১ সালে স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ ২০ হাজার ৬৮৪ টাকা। পাঁচ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ২৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ১৪০ টাকা।
এবং গৌতম
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের সব থেকে আলোচিত নেতা এবং মন্ত্রী গৌতম দেব। ২০১১ সালের হলফনামা অনুযায়ী তাঁর হাতে নগদ টাকা, ব্যাঙ্ক, শেয়ারে বিনিয়োগ, গাড়ি মিলিয়ে মোট অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকা। তাঁর স্ত্রীর নামে ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ টাকার। গৌতমবাবুর অস্থাবর সম্পত্তির সাম্প্রতিকতম বাজার দর প্রায় ৬২ লক্ষ টাকা। আর স্থাবর সম্পত্তি? হলফনামা মতে ৫১ লক্ষ। যার মধ্যে শিলিগুড়ির কলেজপাড়ায় ১,৯৫৭ স্কোয়ার ফুটের বাড়ি এবং কলকাতার যাদবপুরে ৪৭৬ স্কোয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।