খড়্গপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রবিবার। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
চৈত্রের শুকনো ধুলো আর ঝোড়ো হাওয়ায় ঘূর্ণি তুলে নামল তাঁর হেলিকপ্টার। আদ্যন্ত টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলে রবিবার নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিলেন, বাংলায় এ বারের ভোটের প্রধান বিষয় দুর্নীতিই। সেই সঙ্গে উন্নয়নের অভাব থেকে শিল্পের বেহাল দশা, বোমা কারখানার রমরমা থেকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে নিজেদের বলে জাহির করা— ‘দিদি’র সরকারের বিরুদ্ধে আছড়ে পড়ল একের পর এক গোলা!
বস্তুত, এর আগে বাংলার নির্বাচনে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো দুর্নীতি এতটা মূল বিষয় হয়ে ওঠেনি। দু’বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে সারদার প্রশ্ন সামনে ছিল ঠিকই। কিন্তু এ বারে সারদার সঙ্গে ‘নারদা’ যোগ হয়ে পটচিত্র অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। ক্যামেরার সামনে টাকা নেওয়ার ছবি স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের দোকান, রাজ্যবাসীর আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে দুর্নীতি। এ দিন প্রধানমন্ত্রীও প্রথম দফার প্রচারে এসে স্পষ্ট করে দিয়ে গেলেন যে, বাংলার ভোট হতে চলেছে দুর্নীতির অভিযোগকে রসদ করেই। বিজেপি-র এক নেতার কথায়, ‘‘আমাদের রাজ্যে এ সব হয় না, এই রকম একটা গর্ব বাঙালির ছিল। প্রধানমন্ত্রী কৌশলে বাংলার সেই অভিমানকেও এ দিন ছুঁয়ে গিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ কি এই রকম দুর্নীতির বাংলা চেয়েছিলেন?’’
দু’বছর আগে লোকসভা ভোটের প্রচারে এসেও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ছিলেন মোদী। কিন্তু সে বার আক্রমণের ধার বেড়েছিল প্রচারের শেষ দিকে। গোড়ায় বরং দিদির ব্যাপারে বেশ নরম মনোভাবই নিয়েছিলেন তিনি। রাজ্যে মমতা, কেন্দ্রে মোদী থাকলে রাজ্যবাসী দু’হাতে লাড্ডু পাবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার আর স্লগ ওভারের জন্য অপেক্ষা নয়। টি-টোয়েন্টির ধর্ম মেনে প্রথম বল থেকেই সংহারমূর্তি! মোদী সরাসরি বলেছেন, ‘‘পরিবর্তন আপনারা চেয়েছিলেন। পাঁচ বছরে পরিবর্তন হয়েছে শুধু দিদির। তাঁর স্বভাব, লক্ষ্য এবং কার্যশৈলীতে পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তায় নেমে যিনি লড়াই করতেন, তিনি এখন শাহেনশা’র মতো যা ইচ্ছে তা-ই করছেন!’’
সেই সূত্র ধরেই মোদী ঢুকে পড়েছেন দুর্নীতির প্রশ্নে। বলেছেন, ‘‘এই পরিবর্তন আপনারা চেয়েছিলেন? এমন দুর্নীতির ছবি বাংলায় দেখেছিলেন? প্রথমে সারদা, এখন ‘নারদা’! গোটা তৃণমূলের নেতৃত্ব ক্যামেরার সামনে এমন ভাবে টাকা নিচ্ছেন যেন হপ্তা তুলছেন! আচ্ছা বলুন, ওঁরা যে টাকা নিচ্ছেন, সেটা কার টাকা? আপনাদেরই টাকা তো লুঠ হয়ে গিয়েছে!’’ খড়্গপুরের রেল ময়দানে রবিবার মোদী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে যখনই একের পর এক তির ছুড়েছেন, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়়েছে ঠাসা ভিড়!
সিপিএম এবং কংগ্রেস অবশ্য এর পরেও ম্যাচ গড়াপেটার তত্ত্ব থেকে সরছে না। বরং মোদী যে ভাবে দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে মমতার বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, সেই দুর্নীতিকে কেন্দ্র করেই বাম-কংগ্রেস আক্রমণ করেছে বিজেপিকেও। প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি নিয়ে যদি মোদী সরকারের এতই মাথাব্যথা, তা হলে সারদা বা ‘নারদা’ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কঠোর হচ্ছে না কেন! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেছেন, ‘‘লোকসভা ভোটের সময়কার চিত্রনাট্যই আবার অনুসরণ করা হচ্ছে! সারদা-কাণ্ডে কারা প্রকৃত প্রভাবশালী, দু’বছরেও সিবিআই তাদের খুঁজে বার করতে পারল না কেন? ঘুষ-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও তদন্ত করল না কেন? ভোটের সময়ে অনেক কথা বলছেন, কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তরে তো প্রধানমন্ত্রী নীরব!’’ উত্তরাখণ্ডের স্টিং অপারেশন নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্র তদন্তের নির্দেশ দিলেও ‘নারদা’য় কেন কিছুই হল না, প্রশ্ন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘অন্দর কি বাত হ্যায়! ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’’
তৃণমূলের তরফে অবশ্য এ দিন লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ছা়ড়া আর কেউ মোদীর বক্তব্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি। সুদীপ বলেন, ‘‘মোদীর গলায় সনিয়া গাঁধী আর সীতারাম ইয়েচুরির সুর শোনা যাচ্ছে! মোদী কি বঙ্গারু লক্ষ্মণের টাকা নেওয়ার কথা ভুলে গেলেন?’’ দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, মোদীর আক্রমণের জবাব আজ, সোমবার দিতে পারেন খোদ মমতাই। প্রথম দফার নির্বাচনের প্রচারে তিনি আপাতত জঙ্গলমহলে। মোদী আসার কয়েক ঘণ্টা আগে এ দিন সকালেই খড়্গপুর ছেড়েছেন। প্রচারসভা থেকেই এর পরে মমতা পাল্টা মুখ খুলবেন বলে তৃণমূল সূত্রের ইঙ্গিত। মোদী সরাসরি দিদিকে আক্রমণ করলেও তৃণমূলের অন্দরে অবশ্য অন্য স্বস্তিও আছে! ‘মোদীভাই-দিদিভাই’ গোপন আঁতাঁত হয়েছে বলে লাগাতার সরব কংগ্রেস ও বাম নেতারা। তার জবাব দিতে মোদী খোলস ছেড়ে বেরোনোয় এ বার মমতাও পাল্টা মুখ খোলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন!
মোদী অবশ্য এ দিন আক্রমণের কোনও সুযোগই হাতছাড়া করেননি। পশ্চিমবঙ্গে জেহাদি কার্যকলাপের অভিযোগ বরাবরই বিজেপি-র বড় হাতিয়ার। সে দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, ‘‘রাজ্যে গ্রামে গ্রামে বোমা তৈরির কারখানা চলছে! দিদি বলছেন, তোমরা বোমা বানাও! মা-বোনেদের তুলে নিয়ে যাও! আইনশৃঙ্খলা কেউ দেখবে না, যা পারো করো! শুধু আমায় ভোটটা দাও!’’
দিদির জমানায় শিল্পের আকাল গত কয়েক বছরে বহুচর্চিত। তাতেই ইন্ধন দিয়ে মোদী এ দিন বলেছেন, ‘‘সিপিএম ৩৪ বছরে শিল্পের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। মা-মাটি-মানুষ বলে এরা শিল্পকে কবরে পাঠিয়েছে! বাংলার মানুষের রোজগারের আশা কিছু আছে?’’ জঙ্গলমহলে যে দু’টাকা কিলো চাল তৃণমূল নেত্রীর অন্যতম তুরুপের তাস, তাকেও বিঁধতে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘গরিব মানুষকে সস্তায় চাল দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কিলোগ্রাম-প্রতি ২৭ টাকা করে ভর্তুকি দেয়। আপনারা যে প্রধান সেবককে দিল্লি পাঠিয়েছেন, তার সরকারই দেয় এটা। আর আপনাদের দিদি বলে বেড়াচ্ছেন, এটা আমি দিলাম!’’
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে বেশ কয়েকটি। প্রথমত, দু’বছর আগের সেই মোদী-হাওয়া এখন তো আর নেই। বিজেপি অন্তত এ রাজ্যে দু’বছরে সেই সংগঠনও গড়ে তুলতে পারেনি। মোদীর এ দিনের ঝোড়ো ইনিংসের ফায়দা কি তারা আসল ম্যাচে তুলতে পারবে?
দ্বিতীয়ত, অনেকেই এ ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের উদাহরণ মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সেখানে দুর্নীতির প্রশ্নে মায়াবতীর বিরুদ্ধে তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়েছিলেন রাহুল গাঁধী। কিন্তু সংগঠনের অভাবে সুবিধা করতে পারেননি। রাজ্যে ফায়দা পেয়েছিলেন শেষমেশ মুলায়ম সিংহ এবং অখিলেশ যাদব। এ রাজ্যেও তেমন হবে না তো?
প্রশ্নটা নিশ্চয়ই মোদীকেও ভাবিয়ে থাকবে! দু’বছর আগেও বাম এবং কংগ্রেসের অবস্থা ছিল ছন্নছাড়া। সেখানে তখন প্রধান বিরোধী হিসেবে উঠে আসার তোড়জোড় করছিল বিজেপি। সেই সময় মোদীর ধারালো আক্রমণ তাঁর দলকে এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দু’বছর পরে রাজ্য বিজেপি আজ অনেকটাই ব্যাকফুটে। বরং বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে কঠিন লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে মমতাকে। মোদীর তর্জনগর্জন আখেরে তাদেরই সুবিধা করে দেবে না তো? মোদী তাই সামনে রেখে গেলেন নিজেকেই! দলের অভিযুক্তদের আড়াল করতে মমতা যেমন বলছেন ২৯৪ কেন্দ্রেই তাঁকে ভোট দিতে, সেই কৌশলই এ দিন শোনা গেল মোদীর মুখে। যখন তিনি বলে গেলেন, ‘‘কে প্রার্থী, তাঁকে আগে দেখেছেন কি না, এ সব ভুলে যান! শুধু বাংলার উন্নয়নের জন্য আমার সব প্রার্থীকে জেতান! আপনারা চাইলে বিজেপি এখানে তুড়ি মেরে সরকার করবে!’’